রাকেশ গুপ্তা
বিহারের সহর্ষ জেলার ঘিনা গ্রাম । গাঁয়ের ছেলে , ১৩ বছরের রাকেশ গুপ্তা একদিন গাঁয়ের পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরছিল । হঠাৎ এক গ্রাম সম্পর্কে চাচা তার পাশে পাশে হাঁটতে লাগল । একথা সেকথার পর হাতের ব্যাগ থেকে কটা বড় বড় লাল লাড্ডু বের করে সে রাকেশকে খেতে দিল আদর করে ।
গরিবের ছেলে রাকেশ । বাড়িতে অনেকগুলি ভাইবােন । মেঠাই মণ্ডা সে বহুবার শহরের দোকানগুলির কাচের শােকেশে সাজানাে থাকতে দেখেছে বটে কিন্তু কোনােদিন চেখে দেখার সৌভাগ্য হয় নি । লাড়ু দেখেই লােভে দু চোখ চকচক করে উঠল তার । সঙ্গে সঙ্গে হাতে নিয়েই মুখে পুরে দিল সে ।
তারপর আর কিছু মনে নেই রাকেশের । সেই দিনই রাতারাতি তার সেই দেশােয়ালি চাচা স্থানীয় দালালের মাধ্যমে তাকে বিহার থেকে পাঞ্জাবের অমৃতসরে পাচার করে দিল । সম্পূর্ণ অচৈতন্য অবস্থায় এক রাজ্য থেকে আর এক রাজ্যে চলে এল রাকেশ ।
জ্ঞান ফেরার পর রাকেশ দেখল সে এক পাঞ্জাবী চাষি পরিবারে কৃতদাস হিসাবে বন্দী । তার সঙ্গে আছে তারই মতাে আরও পাঁচজন বালক । কিন্তু রাকেশকে নিয়ে তার ক্রেতা অর্থাৎ মনিব মােটেই খুশী হতে পারল না । কারণ বিহারের ছেলে রাকেশ তার গুমুখী ভাষার বিন্দুবিসর্গ বােঝে না । শুধু বকে বকে মরতে হয় তাকে । গরুর মতাে মার , গালাগাল আর না খেতে দিয়ে দিনের পর দিন ঘরে তালাবন্ধ করে রাখার পরও যখন রাকেশের ভাষাজ্ঞানের কিছুমাত্র উন্নতি হল না , তার শিখ মনিব তখন তাকে বেচে দিল আর একজনের কাছে । এই নতুন প্রভু বেশ মােটা দামে রাকেশকে কিনেছিলেন । কাজেই খাটিয়ে সেই টাকা সুদে আসলে উশুল না করে ছেড়ে দেবার পাত্র তিনি নন ।
শুরু হল তেরাে বছরের ক্রীতদাস রাকেশকে পুরােপুরি ব্যবহার করা । সকালে উঠেই রাকেশ মােষগুলােকে স্নান করায় বালতি বালতি জল তুলে এনে । তারপর চলে যায় মাঠে । সেখানে গমের ক্ষেতে কাজ করে সারাদিন । সন্ধ্যাবেলা বাড়ি ফিরে এলে দুখানি শুকনাে রুটি খেতে দেওয়া হয় তাকে ।
সারা দিনে রাত্রে মাত্র দুখানি শুকনাে রুটি আর ছােটো গ্লাসে আধ গ্লাস চা । প্রায় দিনই ক্ষিদের জ্বালায় জ্ঞান হারাতাে রাকেশ । তখন তার কপালে জুটত লােহার রডের বাড়ি প্রচণ্ড প্রহার । প্রহারের হাত থেকে বাঁচবার জন্য ক্ষিদেয় ক্লান্তিতে ধুকতে ধুকতে কাজে যেতে হত রাকেশকে ।
এভাবেই হয়তাে একদিন ক্ষিদের জ্বালায় মাঠের মধ্যেই মরে পড়ে থাকতে হতাে রাকেশকে কিংবা মালিকের প্রহারে খুন হতাে সে । কিন্তু ভাগ্যটা তার অত খারাপ ছিল না ।
বছর পাঁচেক বিস্তর খোঁজাখুঁজি আর প্রশাসনের দোরে দোরে প্রচুর ঘােরাঘুরি । শেষপর্যন্ত পুলিশ খুঁজে বের করল রাকেশকে । কিন্তু তখন সে প্রায় পঙ্গু । মানসিক কিছু জটিলতাও দেখা দিয়েছে তার মধ্যে । নিয়মিত ড্রাগ খাওয়ানাের ফলে সে তখন এক অর্ধমৃত , রুগ্ন , অসংলগ্ন কথাবার্তা বলা আধপাগলা কিশাের যার আশ্রয় মানসিক চিকিৎসা কেন্দ্র ছাড়া আর কোথাও নয় ।
কিন্তু মনের জোর রাকেশকে এখানে থামতে দিল না । তার বাবা তাকে স্কুলে ভর্তি করে দিলেন । ধীরে ধীরে রাকেশ আবার তার মাতৃভাষা হিন্দি বলতে বুঝতে ও লিখতে পড়তে শিখে গেল । তারপর সে শুরু করল এই নিষ্ঠুর সমাজের দিকে তার ঘুরিয়ে মার ।
২০০৬ সালে বিশ্বে শিশুর অধিকার রক্ষার বিষয়ে একটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার নেবার জন্য সুইডেনে উপস্থিত হয়েছিল সে । সেখানে বিচারকবৃন্দ ও হাজার হাজার দর্শকদের সামনে দাঁড়িয়ে সে তার নিজের ভাষায় বর্ণনা করেছিল তার অমানুষিক জীবনসংগ্রামের কাহিনি । তার পরিণত বুদ্ধি , সংবেদনশীলতা ও অভিজ্ঞতার পরিচয় পেয়ে বিচারকরা তাকে অন্যতম জুরি হিসাবে নির্বাচন করেছেন । তার কাজ হল ২০১৩ সাল পর্যন্ত পুরস্কার প্রাপক শিশুদের মনােনীত করা ।
জীবনের লড়াইটা এভাবেই একেবারে গােহারা হারতে হারতে হঠাৎ জিতে গেল রাকেশ দারুণভাবে । কে জানে কার জন্যে কি পুরস্কার তােলা আছে ভাগ্যদেবতার হাতে । মানুষের কাজ শুধু লড়াইটা টেনে নিয়ে চলা । কখনােই লড়াইটাকে থামতে না দিয়ে লাগাতার চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার নামই তাে জীবন ।
রাকেশ এখন প্রতিদিন সকালে উঠে ধ্যান করে । ঈশ্বরের কাছে তার একমাত্র প্রার্থনা— জীবনের হেরে যাওয়া , মার খাওয়া শিশুদের পিঠে । সে যেন তার নিজের হাতখানা রাখতে পারে । যেন গভীর বিশ্বাস । মিশিয়ে বলতে পারে—
‘ভয় পেয়াে না । আমি তাে আছি । আমরা তাে আছি ।'
সমাপ্ত
0 Comments: