স্বামী বিবেকানন্দ
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট বলেছিলেন— The future belongs to those who believe in the beauty of their dreams .
স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন এমনি একজন স্বপ্নদ্রষ্টা মানুষ । তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন তাঁর স্বদেশবাসী , পরাধীন , পদদলিত , দরিদ্র মূখ চির হতভাগ্য এই ভারতবাসীরা একদিন মানুষের মতাে মানুষ হয়ে উঠবে । ফিরে পাবে আত্মমর্যাদা , ফিরে পাবে স্বাধীনতা । জ্ঞানে , গরিমায় , শক্তিতে সাহসে এই অবহেলিত ঘৃণিত ভারতবর্ষই একদিন বিশ্বসভায় শ্রেষ্ঠত্বের আসন গড়ে নেবে ।
এ স্বপ্ন যখন তিনি দেখেন তখন তিনি একজন কপর্দকশূন্য কৌপীন মাত্র সম্বল সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী । কখনাে ভিক্ষান্নে , কখনাে কোনাে সদাশয় গৃহস্থের দানে গ্রাসাচ্ছাদন চলে তার । তবু তিনিই এই স্বপ্ন দেখেছিলেন ।
কিন্তু কে শুনবে তাঁর কথা ? অভাত অখ্যাত সন্ন্যাসীকে সাহায্য করতে কে আসবে এগিয়ে ?
অথচ দেশকে জাগাতে হলে চাই সংগঠন , চাই প্রচার আর চাই প্রচুর অর্থ ।
পথ খুঁজতে লাগলেন স্বামীজি । কেমন করে স্বপ্নকে সার্থক করা যায় তারই পথ ।
হঠাৎ একটা খবর পৌছুল তার কানে । আমেরিকার শিকাগাে শহরে বিশ্বধর্ম মহাসম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে । এই সম্মেলনে উপস্থিত হয়ে তিনি যদি হিন্দুধর্মের ওপর ভাষণ দেবার সুযােগ পান তাহলে তিনি প্রমাণ করে দিতে পারবেন যে হিন্দুধর্ম পৃথিবীর কোনাে ধর্মের চেয়ে ছােটো নয় বরং পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনাে , সবচেয়ে উদার আর সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ধর্ম হল হিন্দু ধর্ম ।
পাশ্চাত্যের মাটিতে দাঁড়িয়ে এই সত্যকে একবার প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে আর ভাবনা কি ? তখন ভারতীয়রাও তাদের আত্মবিশ্বাস , আত্মমর্যাদা বােধ ফিরে পাবে । তখন আর তারা দলে দলে খ্রিস্টান হতে ছুটবে না ।
নিজের ধর্ম , নিজের জাতি , নিজের দেশকে ভালােবাসতে শিখবে , শ্রদ্ধা করতে শিখবে ।
আর অর্থের অভাব ? একবার বিদেশের মাটিতে প্রতিষ্ঠা পেলে সে অভাবও দূর হয়ে সহজেই । শুধু বক্তৃতা দিয়েই উপার্জন করতে পারবেন রাশি রাশি টাকা । অতএব যেতেই হবে আমেরিকা । স্বপ্নে স্পষ্ট নির্দেশ দিয়ে গেছেন গুরু শ্রীরামকৃষ্ণ । গুরুমা সারদাদেবীও পাঠিয়েছেন আশীর্বাদ ।
কিন্তু কোথায় পাথেয় ? কোথায়ই বা বিদেশ যাত্রার উপযুক্ত পােশাক ? খেতড়ির রাজা এগিয়ে এলেন । দিলেন প্রয়ােজনীয় টাকাপয়সা ও জামাকাপড় ।
স্বামীজি ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দের ৩১ মে বােম্বাই বন্দর থেকে জাহাজে উঠে আমেরিকার পথে পাড়ি দিলেন । চলেছেন কিন্তু জানেন না কোথায় গিয়ে উঠবেন । কারণ ধর্মমহাসভার পক্ষ থেকে তাকে কোনাে আমন্ত্রণপত্র পাঠানাে হয় নি । সে দেশে কোনাে চেনাজানা লােকও নেই তার । এমনকি একটি পরিচয়পত্র পর্যন্ত সঙ্গে নেই তার যা দিয়ে তিনি নিজেকে প্রমাণ করবেন ।
শুধুমাত্র একবুক স্বপ্ন আর গুরুর আদেশ সম্বল করে ৩০ জুলাই এক কনকনে শীতের রাত্রে শিকাগাে শহরে এসে পৌঁছলেন স্বামীজি ।
বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ধনীদের শহর । হােটেলের চার্জ নাগালের বাইরে । এদিকে সঙ্গে আনা টাকাপয়সাও প্রায় ফুরিয়ে এসেছে । তারপর বর্ণবিদ্বেষী শ্বেতাঙ্গরা খাবারের দোকানে ঢুকতে দেয় না , চুল কাটার সেলুনে ঢুকতে দেয় না , গৃহস্থ বাড়িতে ভিক্ষা চাইলে কেউ ভিক্ষাও দেয় না । মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দেয় ।
স্বামীজি বুঝলেন এভাবে শিকাগাে শহরে আর কয়েকদিন থাকলে অনাহারেই মারা যাবেন । তার ওপর প্রচণ্ড শীত । সঙ্গে আনা পােশাকগুলােও প্রায় ছিড়ে গেছে । এই নিদারুণ সময়ে স্বামীজি দেশে তার এক গুরুভাইকে চিঠিতে লিখছেন—
‘ এখানে আসিবার পূর্বে যে সব সােনার স্বপ্ন দেখিতাম তাহা ভাঙিয়াছে । এক্ষণে অসম্ভবের সঙ্গে যুদ্ধ করিতে হইতেছে ।... মরি - বাঁচি , আমার উদ্দেশ্য ছাড়িতেছি না । '
শিকাগাে থেকে কিছু দূরে বােষ্টন শহর । সেখানে থাকা খাওয়ার খরচ কিছুটা কম । স্বামীজি চললেন বােষ্টনের উদ্দেশ্যে । পথে ট্রেনে এক দয়াবতী মহিলার সঙ্গে আলাপ হল তার । তিনি স্বামীজির সব কথা শুনে তাকে নিজের বাড়িতে অতিথি হিসাবে আশ্রয় দিলেন । থাকা খাওয়ার সমস্যা মিটল ।
কিন্তু আসল কাজের তাে কিছুই হল না । যে জন্য এতাে দূরে , এতাে কষ্ট স্বীকার করে আসা সেই বিশ্বধর্ম সম্মেলেনের মহাসভায় যােগ দেবার কোনাে সুরাহাই তাে হল না ! তবে কি শূন্য হাতেই ফিরে যেতে হবে ? স্বামীজি হাল ছাড়লেন না । মানুষের জেদের পরিচয় পেলে ঈশ্বরও হাত বাড়িয়ে দেন ।
হঠাৎই একদিন পথ চলতে চলতে স্বামীজির আলাপ হয়ে গেল মি . রাইটের সঙ্গে । মাত্র তিনঘণ্টার আলাপে অধ্যাপক রাইট এতােটাই অভিভূত হয়ে পড়লেন যে নিজেই উদ্যোগ নিয়ে নিজের এক বন্ধু জে এইচ ব্যারেজের কাছে চিঠি লিখে স্বামীজির হাতে দিয়ে তাকে শিকাগাে শহরে পাঠিয়ে দিলেন । মি ব্যারেজ ছিলেন এমন এক সভার সদস্য যে সভার হাতেই ছিল ধর্মসম্মেলনের প্রতিনিধি নির্বাচনের ভার ।
ডক্টর রাইটের চিঠি নিয়ে স্বামীজি আবার ফিরে এলেন শিকাগাে শহরে । কিন্তু ট্রেন ঢুকতে দেরী করল । গভীর রাত । ঝােলা ঝুলি হাতড়ে খুঁজতে লাগলেন অধ্যাপক রাইটের দেওয়া চিঠি আর সমিতির ঠিকানা । কিন্তু কোথায় সে সব । পথের মধ্যে মনের ভুলে কোথায় ফেলে এসেছেন কে জানে ! সঙ্গে টাকাপয়সাও নেই । কোনাে হােটেলেও ঠাই হলাে না । হাড় কাপানাে ঠাণ্ডায় হাত - পা অসাড় হয়ে গেছে । মৃত্যু অবধারিত ।
এমন সময় হঠাৎ চোখে পড়ল একটি কাঠের খালি প্যাকিং বাক্স স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের এক কোণে পড়ে আছে । স্বামীজি সে রাতের মতাে সেই বাক্সের মধ্যে ঢুকে কোনােমতে প্রাণ বাঁচালেন । সারারাত কেটে গেল অনাহারে । তবু হাল ছাড়লেন না । সকালে উঠেই ক্লান্ত অবসন্ন পায়ে ফের বেরিয়ে পড়লেন সমিতির খোঁজে ।
কিন্তু খোঁজ তাে পেলেনই না উপরন্তু বিস্তর হাঁটাহাঁটি করে খিদে আরাে বেড়ে গেল । নিরুপায় স্বামীজি ভিক্ষা চাইতে লাগলেন দ্বারে দ্বারে এককণা খাবারের জন্য । কিন্তু ধনী , অহংকারী আমেরিকান গৃহস্থরা এক মুঠো খাবার তাে দিলই না বরং যারপরনাই অপমান করে তাকে - তাড়িয়ে দিল । এ দুয়ার থেকে ও দুয়ার ক্রমাগত বিতাড়িত হতে হতে একসময় স্বামীজি আর পারলেন না । খিদেয় লুটিয়ে পড়লেন রাস্তার মাঝখানে ফুটপাতের ওপর ।
এই দৃশ্য উল্টোদিকের বাড়ির বারান্দা থেকে দেখতে পেয়েছিলেন এক দয়াবতী মহিলা মিসেস হেল । তিনি তক্ষুনি নিজে গিয়ে স্বামীজিকে বাড়িতে ডেকে নিয়ে এলেন । যত্ন করে তাকে খাওয়ালেন । বিশ্রামেরও ব্যবস্থা করে দিলেন ।
কিন্তু স্বামীজি তাে সাধারণ ভিক্ষুক নন । তিনি তাে চান ধর্মসভায় বক্তৃতা দিতে । তিনি তাে থাকা খাওয়ার নিশ্চিত আশ্রয় পেয়েই সন্তুষ্ট থাকতে পারেন না । তাই সময় বুঝে একদিন বলে ফেললেন মিসেস হেলকে তার মনের কথা । ব্যাকুল হয়ে প্রার্থনা করলেন তার সাহায্য ।
অনেক চেষ্টা করে শেষপর্যন্ত ব্যবস্থা একটা হল । হিন্দু ধর্মের প্রতিনিধি হিসেবে ইতিমধ্যে অনেকেই পৌঁছে গেছেন । অভ্যর্থনা সমিতির অতিথি নিবাসে । সেইসব ভারতীয়ের মধ্যে বেশ কজন বাঙালিও আছেন । কাজেই হিন্দু ধর্মের ওপর বলার জন্য যে সময়সীমা নির্দিষ্ট করা আছে তা আর কোনাে মতেই বাড়ানাে যাবে না । তবে একান্তই নাছােড়বান্দা এই তরুণ সন্ন্যাসীর জন্য অনেক বলে কয়ে কোনােমতে দু মিনিট সময় বরাদ্দ করা গেল । স্বামীজি তাতেই সন্তুষ্ট হলেন । মনে মনে প্রস্তুত করতে লাগলেন নিজেকে । ওই দু মিনিট সময়কেই কিভাবে পুরােপুরি কাজে লাগানাে যায় তাই ভাবতে লাগলেন দিন রাত ।
১৮৯৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর শিকাগাের কলম্বাস হলে শুরু হল বিশ্বধর্ম মহা সম্মেলন । পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা বাছা বাছা সাত হাজার মহাপণ্ডিত সেই সভার দর্শকাসনে । এছাড়া বক্তা হিসাবে যাঁরা বসে আছেন মঞ্চে তাদের পাণ্ডিত্য তাে সন্দেহাতীত । এই সভায় দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করতে হবে ভেবে ভয়ে স্বামীজির কণ্ঠ তালু শুকিয়ে গেল , বুকের মধ্যে দুরু দুরু । জীবনে যে কখনাে তিনি মঞ্চে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করেন নি । তাছাড়া সকলেই বক্তৃতা লিখে নিয়ে গিয়েছিলেন । স্বামীজি তাও করেন নি ।
একমনে গুরুকে স্মরণ করে স্বামীজি নিজের নিলেন । ঘােষক তার নাম ঘােষণা করতেই ধীর পায়ে মঞ্চে উঠে এলেন মনকে প্রস্তুত করে স্বামীজি । তার তরুণ তেজপূর্ণ চেহারা , গৈরিক পােশাক ও আত্মবিশ্বাস মাখানাে দুটি চক্ষুর নির্মল জ্যোতি দর্শকদের মুগ্ধ করে দিল । স্বামীজি শুরু করলেন—
‘ আমেরিকাবাসী ভগ্নী ও ভ্রাতাগণ’– সভাকক্ষে , যেন বিদ্যুত চমকিত হল । শ্রোতারা আনন্দে আত্মহারা হয়ে করতালি দিতে লাগল । এতাে আন্তরিক সম্বােধন আগে কোনাে বক্তা তাে করেননি । মুগ্ধ করতালি চলল টানা দু মিনিট ধরে ।
এরপর স্বামীজি যা বললেন তার সারসংক্ষেপ হল এই - বিশ্বের সব ধর্মই মহান । সব ধর্মেরই লক্ষ্য এক ঈশ্বর । হিন্দুধর্মের মহান্থি গীতা এই সত্যকেই প্রকাশ করেছে । আজকের এই ধর্মহাসম্মেলন বিশ্ব থেকে ধর্মান্ধতা , সংকীর্ণতা , সাম্প্রদায়িকতা ও যাবতীয় ধর্মোন্মত্ত পৈশাচিকতাকে দূর করুন । তুমুল করতালির মধ্যে বক্তৃতা শেষ হল ।
জনপ্রিয়তার প্রবল স্রোতে ভেসে গেলেন স্বামীজি । আমেরিকাবাসীর মুখে মুখে ফিরতে লাগল তার নাম । সবাই তার কথা শুনতে চায় । ফলে আরাে দশ বারােদিন ভাষণ দিতে হল তাকে ধর্মসভায় ।
না , আর ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে । এরপর দিনের পর দিন , মাসের পর মাস , বছরের পর বছর , আমেরিকা , লন্ডন সহ পাশ্চাত্যের নানা দেশে বক্তৃতা করে বেড়িয়েছেন তিনি । পৃথিবীর দিগভ্রান্ত , নষ্ট চৈতন্য , হতাশ মানুষের কাছে পৌছে দিয়েছেন জীবনের মহামন্ত্র -
‘ উত্তিষ্ঠত জাগ্রত প্রাপ্য বরাণ নিবেধিত ।
Arise , awake stop return till you reach the goal .
আজ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে স্বামী বিবেকানন্দ প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের অসংখ্য শাখাপ্রশাখা । শিবজ্ঞানে জীবসেবাই যার একমাত্র উদ্দেশ্য । বিবেকানন্দ রচিত প্রচুর বই ও বক্তৃতামালা আজ বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে সঞ্চারিত করে । দিচ্ছে দিব্যজীবনের , প্রকৃত আনন্দময় জীবনের মন্ত্র
- He only lives , who lives for others .
- Swami Vivekananda
0 Comments: