চার্লি চ্যাপলিন
বিশ্বের সর্বকালের সবসেরা কৌতুকাভিনেতা চার্লি চ্যাপলিন । মানুষের ভাবভঙ্গী , কথাবার্তা নকল করে দর্শককে হাসিয়ে হাসিয়ে একেবারে লুটোপুটি খাইয়ে দেবার আশ্চর্য কৌশল জানা ছিল তার । সারা পৃথিবীর অসংখ্য সিনেমা অনুরাগী মানুষ চার্লি চ্যাপলিনের গুণমুগ্ধ । নিজের কাজের স্বীকৃতিতে প্রচুর পুরস্কার পেয়েছেন তিনি । কোটি কোটি টাকা উপার্জনও করেছেন দু হাতে । কিন্তু নিজের অতীত দিনগুলাের কথা যখন মনে পড়ত তার তখন হয়তাে এই দুরন্ত রসিক মানুষটিরও চোখের কোণে জমে উঠত দু - ফোটা জল ।
সমস্ত শৈশবটাই চার্লির কেটেছে দুঃসহ দারিদ্র আর অপমানের মধ্যে । ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে লন্ডন শহরে তার জন্ম । বাবা - মায়ের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে গেল । অনেকগুলি ভাই বােনকে নিয়ে মা পড়লেন নিদারুণ অসহায় অবস্থার মধ্যে । মা ছিলেন অভিনেত্রী । তবে নিয়মিত কাজ পেতেন না । যখন কাজ থাকত না তখন উপােস করে কাটাতে হত সারাটা দিন । নিজে নয় কোনােরকমে সহ্য করতেন কিন্তু ছােটোছােটো অবােধ শিশুগুলি খিদের জ্বালায় যখন চিৎকার করে কাঁদত , তখন আদর করে , গল্প বলে , ভয় দেখিয়ে কোনােমতেই বেচারী মা বাচ্চাগুলিকে ভােলাতে পারতেন না ।
শেষে এক অদ্ভুত কৌশল বার করলেন তিনি । লন্ডনের বস্তি অঞ্চলে , ছােট্ট ঘুপচি যে ঘরটায় তারা থাকতেন ঠিক তার পাশেই ছিল জনসাধারণের চলার পথ । মা তার বাচ্চাগুলিকে নিয়ে সেই পথের পাশে জানলার ধারে এসে দাঁড়াতেন । নানারকমের মানুষ চলে যেতাে একের পর এক । তাদের কেউ বেঁটে , কেউ ঢ্যাঙা , কেউ রােগা লিকপিক করছে , কেউ বা আবার হাঁসফাস করতে করতে হেলেদুলে চলেছে অতিরিক্ত মেদের ভারে ।
লােকগুলি দেখতে শুধু বিচিত্র নয় , তাদের হাবভাবও বিচিত্র । কেউ হাসতে হাসতে চলেছে , কেউ ভিখারি , কেউ যেন ভয় পেয়ে সন্ত্রস্ত হয়ে দৌড়ে পালাচ্ছে , কেউ চলেছে অন্যকে গালি দিতে দিতে , গজগজ করতে করতে । আবার কেউ বা উদাসীন । অন্যমনস্ক ভাবে চলেছে কিছু যেন ভাবতে ভাবতে । মা ছেলেদের ডেকে ডেকে পথিকদের দিকে আঙুল তুলে দেখাতেন , তারা অবাক হয়ে দেখত কান্না ভুলে ।
-দেখ দেখ ওই লােকটা কেমন চোখ মটকে তাকাচ্ছে । চারদিকে । ঠিক এইরকম না ? এই বলে তিনি লােকটির ভাবভঙ্গী অবিকল নকল করে দেখাতেন । হৈ হৈ করে হেসে উঠত বাচ্চাগুলাে ।
ঘােড়ার পিঠে একজন সৈনিক চলে গেল অহঙ্কারী ভঙ্গিতে । মা অমনি তার ভঙ্গী নকুল করে দেখাতে লাগলেন । আবার হেসে লুটিয়ে পড়ল । বাচ্চারা । এভাবে হাসতে হাসতে হঠাৎ একসময় ঘুমিয়ে পড়ত তারা ক্লান্ত হয়ে । চার্লির মা ভাবতেন , যাক একদিনের সমস্যা কোনােমতে মিটল ।
কিন্তু মা নিজে ঘুমােতে পারতেন না ।
সন্তানদের ভবিষ্যতের চিন্তা ও খিদের জ্বালায় দিনের পর দিন জেগেই কেটে যেত তার সারাটা রাত । এভাবে দিনের পর দিন শরীর ও মনের ওপর চাপ সহ্য করতে না পেরে চার্লির মা উন্মাদ হয়ে গেলেন ।
বড়াে ছেলে চার্লির মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল । বেঁটেখাটো চেহারার ,দূর্বল , অপুষ্টিতে ভােগা ছােট্ট ছেলেটি । লেখাপড়াও প্রায় শেখেননি বললে চলে । কে কি কাজ দেবে তাকে ? শেষে মায়ের শিখিয়ে দেয়া পথেই মাকে অনুসরণ করলেন তিনি ।
মানুষকে নকল করার মধ্যে একটা দারুণ মজা আছে । একটা নির্দোষ নির্মল আনন্দ যা সবাই মিলে ভােগ করা যায় অথচ তার জন্যে কোনাে পয়সা লাগে না । চার্লি লােককে ডেকে ডেকে ক্যারিকেচার করে দেখাত । কখনাে তার নিজের , কখনাে পরিচিত বা বিখ্যাত কোনাে ব্যক্তির । লােকে উদ্দাম হাসিতে ফেটে পড়ত । দু - চার পেন্স পকেট থেকে বের করে বাচ্চাটির হাতে গুঁজে দিত তারা স্বতঃফুর্ত ভাবে ।
একটু একটু করে উপার্জন বাড়তে লাগল । ছােটো ভাইবােনগুলির জন্য খাবার কিনে এনে , তাদের খাইয়ে দিত চার্লি । তারপর মায়ের সেবা করত । ওষুধ খাওয়াতাে , ঘুম পাড়াত । অবসর পেলেই বসত গিয়ে পথের পাশের সেই জানলায় ।
ধীরে ধীরে ভালাে হয়ে উঠলেন মা । দুটি একটি শাে করতে লাগলেন । কিন্তু চার্লি ততদিনে দক্ষ , অভিনেতা হয়ে উঠেছে । মা - কে আর কাজ করতে দেবে না ।
যেদিন মা স্টেজে নিজের শেষ শাে করলেন , সেইদিন সেই স্টেজেই । চার্লি চ্যাপলিনের হল অভিষেক , তার প্রথম শাে । তারপর থেকে আর একটি দিনও পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে । জগৎ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল চার্লির খ্যাতি । ইংল্যান্ডের রানি এলিজাবেথ তাকে দিলেন নাইট উপাধি । সেকালে সিনেমায় কথা ছিল না । তার সিনেমার গল্পগুলাে চার্লি নিজেই লিখতেন , পরিচালনাও করতেন আবার মূল চরিত্রে অভিনয়ও করতেন , নিজেই । গােল্ডরাশ , সিটি লাইটস মডার্ন টাইমস— এসব চার্লির বিখ্যাত সিনেমা । দুঃখদারিদ্র এসব হল ঈশ্বরের গােপন আশীর্বাদ কারণ এগুলিই খুলে দেয় ভবিষ্যতের স্বর্ণদুয়ার ।
চার্লি চ্যাপলিন কি স্বপ্নেও ভাবতে পেরেছিলেন যে নিঃসীম দারিদ্র্যই তার জীবনে একদিন প্ৰবতারা হয়ে সফলতার পথটি দেখিয়ে দেবে । জীবনে উপচে পড়বে অর্থ , যশ আর আনন্দ !
0 Comments: