কলম্বাস
কলম্বাস যে আমেরিকা আবিষ্কার করেছিলেন একথা তােমরা সবাই জানাে । কিন্তু এই আবিষ্কারের পিছনে যে কী ভীষণ সংগ্রাম আর কী মরণপণ ঝুঁকির ইতিহাস লুকিয়ে আছে , সেই গল্পই আজ তােমাদের শােনাব ।
ক্রিস্টোফার কলম্বাস ছিলেন ইতালির এক হতদরিদ্র পরিবারের ছেলে । কিন্তু গরিবের ঘােড়া রােগ হবার মতাে গরিবের ছেলে কলম্বাসও স্বপ্ন দেখতেন একদিন মস্ত বড়াে নাবিক হবেন । শহরে সমুদ্র ফেরৎ কোনাে নাবিক এলেই কলম্বাস ইনিয়ে - বিনিয়ে তার সঙ্গে ভাব জমাত , তারপর ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে বসে শুনতে উত্তাল তুফান , ডুবুডুবু জাহাজ , জীবন - মৃত্যু একটি বিন্দুতে এসে দাঁড়ান ইত্যাদি নানা রােমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার গল্প । এসব কাহিনি শুনতে শুনতে তিনি বিভাের হয়ে যেতেন আর ভাবতেন কবে কেমন করে তিনিও একদিন ভেসে পড়বেন অকূলে উন্মাদ সমুদ্রের ওপর দিয়ে ভাসতে ভাসতে পৌছে যাবেন অজানা অচেনা কোনাে এক স্বপ্নের দেশে ।
এসব আজ থেকে প্রায় পাঁচশাে বছর আগেকার কথা । তখন ইউরােপ থেকে ভারতে আসতে হলে পূর্বদিকে পারস্য উপসাগরের ওপর দিয়ে জাহাজে চড়ে আসতে হত । এছাড়া অন্য কোনাে পথ ছিল । সময়ও লেগে যেত মাসের পর মাস , পথে বিপদও ছিল প্রচুর ।
ইতিমধ্যে গ্যালিলিও আবিষ্কার করেছেন যে পৃথিবী গােল । কলম্বাস ভাবলেন , পৃথিবীটা যদি গােলই হয় তবে পূর্বদিক দিয়ে গেলে যেখানে পৌছনাে যাবে পশ্চিম দিক ধরে গেলেও সেইখানেই পৌছানাে যাবে । তিনি যাকেই পান তাকেই তার এই বিশ্বাসের কথা বলেন আর বলেন , একটু সুযােগ যদি কেউ করে দেয় তবে তিনি হাতেনাতে প্রমাণ করে দেখাবেন । কিন্তু কলম্বাসের কথা শুনে সকলেই হেসে উড়িয়ে দিত । কেউ সমর্থন করলেও কি করে এটা বাস্তবে করে দেখানাে সম্ভব হবে সে ব্যাপারে কোনাে হদিশ দিতে পারত না ।
এদিকে কলম্বাসের মাথায় জেদ চেপে গেছে । শেষকালে এমন হল , নাওয়া নেই , খাওয়া নেই , সমস্ত দিনরাত তিনি মশগুল হয়ে রইলেন সমুদ্রপথে ভারতযাত্রার স্বপ্নে । দেশের যেখানে যত ধনী লােক আছে । তাদের ঠিকানা যােগাড় করে , তিনি তাদের কাছে চিঠি পাঠাতে লাগলেন নিজের পরিকল্পনার কথা জানিয়ে । এমনকি ইতালির বাইরে ইউরােপের অন্যান্য দেশের ধনী ব্যক্তিদের কাছেও দিনের পর দিন চিঠি লিখে চললেন কলম্বাস । রাজা মহারাজারাও বাদ গেলেন না ।
কিন্তু কে কলম্বাস ? একটা গরিব মুখ - সুখ লােক তার না আছে । কোনাে অভিজ্ঞতা না আছে লােকবল কিংবা অর্থবল । কেউ চেনে না , কেউ জানে না , এমন লােককে বিশ্বাস করে কে দেবে টাকা পয়সা , জাহাজ আর লােকলস্কর ? কোনাে চিঠিরই উত্তর এল না । কলম্বাসও হাল ছাড়লেন না ।
আমরা যে সময়ের কথা বলছি , সে সময়টা ছিল ইউরােপের ব্যবসা বিস্তারের যুগ । শিল্পবিপ্লবের ফলে ইউরােপের কলকারখানায় রাশি রাশি উৎপাদন হয় । সে সব জিনিস বিক্রির জন্য চাই নতুন নতুন দেশে নতুন নতুন বাজার । তাই স্পেন , পর্তুগাল , ইতালি রােম , ইংল্যান্ড , ফ্রান্স সকলেই বড়াে বড়াে জাহাজ নিয়ে নেমে পড়েছিল সমুদ্রে । স্পেন আর পর্তুগাল আবার সবচেয়ে বাণিজ্যে এগিয়ে কারণ তাদের দেশের লােকেরা ছিল নৌকা চালানাের ওস্তাদ । এইরকম একটা সময়ে কলম্বাসের প্রস্তাবটা মােটেই হেলাফেলা করার মতাে নয় বরং যথেষ্ট লােভনীয় । তবু যেহেতু সে বেচারা গরিব , অনভিজ্ঞ আর অজ্ঞাত - অখ্যাত তাই তার কথাটায় কেউ পাত্তাই দিল না ।
কলম্বাসও হাল ছাড়লেন না । এক বছর গেল , দুবছর গেল ক্রমে একদিন ঘুরতে ঘুরতে কলম্বাস এসে পড়লেন পর্তুগালে । যাকে পান তাকেই বলে বেড়ান তার পরিকল্পনার কথা । রাজবাড়িতে তাে ঢুকতে পান না তাই রাজার কাছে আসা - যাওয়া আছে এমন লােক খুঁজে খুঁজে তাদের কাছে বলেন সব । যদি কোনে সুরাহা হয় ।
ক্রমে রাজার কানে কথাটা পৌছল । তিনি ভালাে মানুষ । তিনি ভাবলেন বেশ তাে , লােকটা যদি সত্যি কোনাে শর্টকাট পথ বার করতেই পারে তাহলে সমুদ্র বাণিজ্য অনেক বেশি সহজ আর লাভজনক হয়ে উঠবে । দেশে আসবে প্রচুর সম্পদ । প্রজারা সুখী হবে । তিনি মন্ত্রীদের বললেন লােকটার সঙ্গে দেখা করে ব্যাপারটার খোঁজ নাও ।
মন্ত্রীরা কলম্বাসকে ডেকে পাঠাল । তারপর তার কাছ থেকে সব কথা শুনে নিয়ে বলল তােমার যাতায়াতের খরচ বাবদ সমস্ত টাকার হিসেব আর যাত্রাপথের একখানা নকশা দাও । রাজাকে দিয়ে মঞ্জুর করাতে হবে । মহা উৎসাহে কলম্বাস সরল মনে তুলে দিলেন সবকিছু তাদের হাতে । এবার শয়তান ধূর্ত মন্ত্রীরা রাজার বরাদ্দ করা টাকা আর কলম্বাসের নকশা নিয়ে গােপনে নিজেরাই কয়েকজন পর্তুগীজ নাবিককে পাঠিয়ে দিলেন পশ্চিমমুখী সমুদ্রপথে । কলম্বাস যখন জানতে পারলেন কি ভয়ানক নির্মমভাবে ঠকানাে হয়েছে তাকে , তখন ক্ষোভে - দুঃখে হতাশায় আর পর্তুগীজদের প্রতি ঘৃণায় সমস্ত অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল তার । কিন্তু হাল ছাড়লেন না ।
আবার পথে এসে দাঁড়ালেন । শূন্য হাতে ঘুরতে ঘুরতে এবার এসে পড়লেন স্পেনে । স্পেনের রানি ইসাবেলার ভারী মায়া হল ছেলেটাকে দেখে আর তার স্বপ্নের কথা শুনে । কিন্তু স্পেন ছােট্ট দেশ , চট করে অজ্ঞাতকুলশীলের মুখের কথায় নেচে লক্ষ লক্ষ টাকা ঢেলে দেওয়া তাে যায় না । তাই তিনি কলম্বাসকে অপেক্ষা করতে বললেন । কলম্বাসও ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে লাগলেন ।
এক বছর দু - বছর করে সাত সাতটা বছর কেটে গেল তার স্পেনের রাজসভায় আবেদন নিবেদন জানাতে জানাতে । ক্রমাগত ফিরিয়ে দিতে দিতে অবশেষে একসময় মন গলল রানির । তিনি আশ্বাস দিলেন সমুদ্রযাত্রার জন্য প্রয়ােজনীয় সব ব্যয় বহন করবে স্পেন ।
ধৈর্যের জয় হল ।
নির্দিষ্ট দিনে ১৪৯২ খ্রি . প্রচুর লােকজন নিয়ে স্পেনের সমুদ্রতীর থেকে যাত্রা শুরু করলেন কলম্বাস । নিনা , পিন্টা আর সান্টামারিয়া এই তিনটি বিশাল বাণিজ্যতরী নিয়ে সােজা পশ্চিমমুখে যাত্রা শুরু করলেন । কলম্বাস ভারতবর্যের উদ্দেশ্যে । এতদিনে স্বপ্ন সত্য হল তার । অথৈ সমুদ্রের বুকে ভেসে চলার দুর্লভ সুযােগ পেয়েছেন তিনি । কিন্তু শেষ রক্ষা হবে কি ? রানির এতগুলি টাকা , এতগুলি মানুষের প্রাণ সব এখন তার হাতে । ভারতবর্ষে পৌছতে পারলে তবেই না সার্থক । যতদিন যায় তত টেনশন বাড়তে থাকে কলম্বাসের ।
দেখতে দেখতে দু - দুটো মাস কেটে গেল । ডাঙ্গার চিহ্নমাত্র নেই । সঙ্গের লােকজন ক্রমশ বিরক্ত হয়ে পড়েছে । খাবারদাবারের ভাণ্ডারও শেষ হয়ে আসছে দ্রুত । নাবিকরা প্রথমে আড়ালে , তারপর প্রকাশ্যেই তার সমালােচনা করতে লাগল । তাকে বার বার চাপ দিতে লাগল দেশে ফিরে যাবার জন্য । তারা বলতে লাগল ঢের হয়েছে । কলম্বাসের মতাে আনাড়ী লােকের সঙ্গে সমুদ্রে আসাটাই তাদের ভুল হয়েছে । এবার মানে মানে দেশে ফিরতে পারলে বাঁচা যায় । না হলে জাহাজ - সুদ্ধ সকলকেই অকূল সমুদ্রের মাঝখানে অনাহারে মরে পচতে হবে । এই বিপদের মধ্যে এল আর এক নতুন বিপদ । দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার ধকলে বা অন্য কোনাে কারণে কলম্বাসের সঙ্গীদের মধ্যে কয়েকজন মারা গেলেন ।
চিন্তার রেখা পড়ল এবার কলম্বাসেরও কপালে । জাহাজের ডেকের ওপর দাঁড়িয়ে দিকচিহ্নহীন সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার কেবলই মনে হতে লাগল তবে কি সবটাই ভুল হল তার ? দিকভ্রষ্ট হয়েছে । তার যাত্রা ? আনাড়ী মানুষের এতখানি ঝুঁকি নেওয়াটা ঠিক হয়নি ?
কিন্তু এতগুলি বছরের স্বপ্ন , এত চেষ্টা , এত অর্থব্যয় সবই কি বৃথা হবে ! একজন বিশ্বাসী নাবিক এসে চুপি চুপি কলম্বাসের কানে কানে বলল নাবিকরা যড়যন্ত্র করছে আপনাকে খুন করার । যদি প্রাণে বাঁচতে চান এখুনি জাহাজের মুখ ঘােরান ।
শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলেন কলম্বাস । মৃত্যুভয় নয় , মানুষের বিশ্বাসঘাতকতা আর ক্ষুদ্রতা তাকে বােবা করে দিয়েছে । কিন্তু না ; হাল ছাড়তে তিনি নারাজ । মেরে ফেলে ফেলুক তবু শেষপর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে যাবেন তিনি । নিচে নেমে এসে নাবিকদের আরাে একবার ভালাে করে বােঝাবার চেষ্টা করলেন । কিন্তু না , কেউ কোনাে কথাই শুনতে রাজী নয় । প্রতিহিংসা , আতঙ্ক আর নিষ্ঠুরতায় জ্বলজ্বল করছে তাদের চোখ । কলম্বাস আবার ফিরে এলেন ডেকে । স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলেন । অন্ধকার সমুদ্রের দিকে ।
এর মধ্যে ৭০ দিন অতিবাহিত হয়ে গেছে । হয়তাে আজকের রাতটাই জীবনের শেষ রাত । প্রিয় পৃথিবী আর অতি প্রিয় এই সমুদ্রকে কলম্বাস শেষবারের মতাে প্রাণভরে দেখে নিতে চান । সমস্ত রাত ওইখানে একভাবে দাঁড়িয়ে রইলেন কলম্বাস । একটি বারের জন্য চোখের পাতা বন্ধ করলেন না । ক্রমে ভাের হয়ে এলাে । পূবের আকাশে দেখা দিয়েছে হাল্কা গােলাপী রঙা ঈশ্বর । শেষবারের মতাে প্রণাম জানিয়ে ডেক থেকে নেমে আসছিলেন কলম্বাস । কিন্তু একটি দৃশ্যে তার চোখ আটকে গেল হঠাৎ । একি ! একটা ভাঙা সবুজ ডাল ! ঢেউয়ের মাথায় মাথায় নাচতে নাচতে ভেসে চলেছে নিরুদ্দেশের পথে ।
তবে কি কাছেই এসে গেছে তীরভূমি ! তবে কি _
কলম্বাস নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলেন না । এবার দূরবীন চোখে দিয়ে দিগন্তরেখার দিকে তাকালেন । ওই তাে ! ওই তাে অস্পষ্ট তটরেখা । ওই তাে জীবনের আশ্বাস , জয়ের বিজয় পতাকা ।
তার চিৎকারে দলে দলে নাবিক ও খালাসীরা জাহাজের ডেকে চলে এলাে । কেউ আনন্দে জড়িয়ে ধরল । কেউ পায়ে পড়ে কাঁদতে কাঁদতে ক্ষমা ভিক্ষা করতে লাগল । কলম্বাস কাউকে কোনাে শাস্তি দিলেন না বা তিরস্কারও করলেন না ।
বহু কষ্টে অর্জন করা জয়ের আনন্দে তিনি তখন আকাশের মতাে মহান ও উদার । মনে মনে তখনই তিনি দ্বীপটির নাম রেখেছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ । তার ধারণা ছিল তিনি ভারতের পশ্চিমের কোন দ্বীপে এসেছেন । আসলে সেটি ছিল আমেরিকার বাহামা দ্বীপপুঞ্জের কাছাকাছি একটি স্থান ।
পরবর্তী কালে আরাে কয়েকবার সমুদ্র অভিযান করে কলম্বাস উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার বেশির ভাগটাই আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন ।
তাই আমেরিকা মহাদেশের সঙ্গে গরীব আনাড়ী নাবিক কলম্বাসের নাম অমর হয়ে থাকবে চিরদিন আর থাকবে নির্ভীক , ধৈর্যবান , কিছুতে হার না মানা , হাল না ছাড়া মানুষদের ইতিহাসে উজ্জ্বল , অম্লান একটি নাম হয়ে ।
0 Comments: