Ishwar Chandra Vidyasagar success story | ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের সফলতার কাহিনী

Bangla success story :- This success story written by Jayanti Chakrabarti.This story revolves around Ishwar Chandra Vidyasagar.We are collected this type success story that revive your lost mind.You get more success story on bengali in our website. And I think  all success story will take place in your mind.So please share this story to your friends and I sure they will also benefit from this success story.Thank you so much.                          

  বিদ্যাসাগর

                      সাগরে যে অগ্নি থাকে 

                                     কল্পনা সে নয় 

                   তােমায় দেখে বিশ্ববাসীর 

                                     হয়েছে প্রত্যয় 

       মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামের এক মাটির ঘরে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যখন জন্মালেন তখন তাঁর বাবা ঠাকুরদাস বাড়িতে ছিলেন । সন্ধ্যাবেলা তিনি যখন বাড়িতে ফিরলেন তখন তার ঠাকুরদাদা জয়রাম তর্করত্ন ছেলেকে ডেকে বললেন , ‘ ওরে আজ একটা এঁড়ে বাছুর হয়েছে । কথাটি তিনি মজা করেই বলেছিলেন- পুত্রসন্তানের জন্ম হয়েছে বােঝাতে । কিন্তু আশ্চর্যরকমভাবে অন্যদিক দিয়ে কথাটা সত্য হয়ে গেল । এঁড়ে বাছুররা ভীষণ একগুঁয়ে হয় । যা জেদ করে ঠিক তাই করে । আমাদের বিদ্যাসাগর , যাঁকে নিয়ে বাঙালির আজ এতাে গর্ব , তিনিও ঠিক এমনি এঁড়ে বাছুরের মতাে একগুয়ে ছিলেন । যা করবেন ভাবতেন তার থেকে তাকে একচুলও নাড়ানাে যেত না । শান্ত সুবােধ বালক বলতে যা বােঝায় তিনি ছিলেন ঠিক তার উল্টো । 

      বাবা যেই বলতেন— ঈশ্বর , নাও স্নান করে নাও । ঈশ্বর অমনি গো ধরে বসতেন না , আজ আমি কিছুতেই স্নান করব না । তার বাবা বলতেন— বাবা ঈশ্বর , জামাকাপড় পরে পাঠশালায় যাও । অমনি ঈশ্বর গোঁ ধরে বসতেন— না , পাঠশালায় যাব না আজ । যাব না তাে যাবই । অনুরােধ , উপরােধ , প্রহার , ভয় কোনাে কিছুতেই তাকে টলাতে পারতাে না । নিজের সংকল্পে পাহাড়ের মতাে অনড় হয়ে থাকতেন তিনি । বাধ্য হয়ে তার বাবা এক উপায় বার করলেন । 

     তিনি স্কুলের বেলা হলে ছেলেকে ডেকে বলতেন— ঈশ্বর , আজ যেন স্নান করাে না । আর স্কুলে গিয়েও কাজ নেই । 

    ম্যাজিকের মতাে কাজ করতে দাওয়াই । ঈশ্বর চটপট স্নান খাওয়া সেরে লক্ষ্মী ছেলে হয়ে বইপত্র নিয়ে স্কুলে চলে যেতেন । 

    এইরকম ভীষণ জেদী ছিলেন বলেই দরিদ্র এক পাড়াগেঁয়ে বালক বিদ্যাসাগর হতে পেরেছিলেন । তেলের অভাবে বাসায় আলাে জ্বলত না । রাস্তার গ্যাসের আলাের নীচে দাঁড়িয়ে পড়তেন তিনি । মেসে থাকতেন । থাকা খাওয়ার বিনিময়ে রান্না করা , বাসনমাজা , বাজার করা এসব করেও তিনি প্রত্যেকটি পরীক্ষায় প্রথম হতেন । পরবর্তী জীবনে তিনি সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ হন , ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের প্রিন্সিপাল এবং সারা দেশের সব স্কুলের ইন্সপেক্টরও হয়েছিলেন তিনি । এই দুর্দমনীয় গোঁ আর স্রোতের বিপরীতে টর্পেডাের মতাে দৌড়ে চলার প্রবণতা সারাজীবন কাজ করে গেছে বিদ্যাসাগরের মধ্যে । কখনাে কোনাে অন্যায়ের কাছে নতিস্বীকার করেন নি । যে কাজ শুরু করেছেন , সহস্র বাধা সত্ত্বেও তা সম্পূর্ণভাবে সমাপ্ত না করা পর্যন্ত এক চুল সরে দাঁড়ান নি সে কাজ থেকে । 

       জলের মতাে অর্থব্যয় হয়েছে , প্রাণ পর্যন্ত বিপন্ন হয়েছে । ঘরে বাইরে সবাই শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে , অতি বিশ্বস্ত স্বজনও গােপনে ষড়যন্ত্রকারীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে । তবু নিজের অভীষ্ট লক্ষ্যে স্থির থেকেছেন বিদ্যাসাগর । ক্ষুব্ধ হয়েছেন , হতাশ হয়েছেন , হাল ছাড়েন নি তবু । সমস্ত ক্লান্তি আর হতাশা নিজের মনের জোরেই ঝেড়ে ফেলে আবার ঝাপিয়ে পড়েছেন সংগ্রামে । 

     তার জীবনের অজস্র ঘটনার মধ্যে একটা ঘটনার কথা বলি । 

     বাংলাদেশের বাল্যবিধবাদের অবর্ণনীয় কষ্ট দেখে দয়ার সাগর প্রতিজ্ঞা করলেন যেমন করেই হােক এদের দুঃখ দূর করতে হবে । কিন্তু আচারসর্বস্ব গোঁড়া হিন্দুদের ঘরে , বিশেষ করে কুলীন ব্রাহ্মণদের পরিবারে বিধবাদের কষ্ট দূর করার মতাে কোনাে পথই নেই । কৌলীন্য ধর্মরক্ষার জন্য ছােটোছােটো বালিকাদের বিয়ে দেওয়া হতাে বৃদ্ধ বরের সঙ্গে । তারা মারা গেলে শিশুকন্যাটি বিধবা হত আর তারপর আজীবন । তাকে পালন করতে হত সুকঠোর ব্রহ্মচর্য । একবেলা নিরামিষ ভাত খেতে পেত সে । একাদশীর দিন নির্জলা উপােষ । যদি কোনাে বালিকা । বিধবা তৃষ্ণায় কাতর হয়ে একফোটা জল পান করে ফেলত তবে তার পিতৃকূলকে সমাজচ্যুত হতে হত । তার ওপর পতি পুত্রহীনা বালিকা বিধবাকে দিয়ে সংসারের সব কাজ করানাে হত দাসীর মতাে । তার জীবনে সাধ আহাদ বলতে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকত না । এতাে অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে অনেক বালিকা বিধবা আত্মহত্যা করতাে , অনেকে বাড়ি থেকে পালিয়ে হারিয়ে যেত সমাজের অন্ধকার গহ্বরে । অনেকে করত দাসীবৃত্তি । অসংখ্য হিন্দুবিধবা কাশীতে গিয়ে বিশ্বনাথ মন্দিরের পথে ভিক্ষা করে প্রাণধারণ করতেন । 

      বিদ্যাসাগর ঠিক করলেন বিধবাদের আবার বিবাহ দিতে হবে । তার এই প্রস্তাবের কথা শুনে রক্ষণশীল ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরা ছি ছি করে উঠলেন । তারা সমস্বরে চিৎকার করে বলতে লাগলেন , এ অন্যায় । অশাস্ত্রীয় । এরকম করলে মহাপাপ হবে । হিন্দুধর্ম ধ্বংস হয়ে যাবে । 

      শিক্ষিত অশিক্ষিত , ধনী , নির্ধন সবার মুখে একই কথা শুনে হতাশ হলেন বিদ্যাসাগর- কিন্তু হাল ছাড়লেন না । রাশি রাশি সংস্কৃত শাস্ত্রগ্রন্থ ঘেঁটে দিনরাত তন্নতন্ন করে খুঁজে বেড়াতে লাগলেন বিধবাদের সপক্ষে কোথাও কোনাে উক্তি আছে কিনা । পেয়েও গেলেন । সমস্ত যুক্তিতর্কের শানিত অস্ত্র দিয়ে সাজিয়ে তিনি একটি পুস্তিকা প্রকাশ করলেন |

      ' বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদবিষয়ক প্রস্তাব ' নামে বইটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে চারিদিকে তর্ক বির্তকের ঝড় উঠল । দলে দলে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরা কলম ধরলেন বিদ্যাসাগরের বিপক্ষে । কিন্তু বিদ্যাসাগরও দমবার পাত্র নন । বিরােধীদের সমস্ত যুক্তিজাল উপযুক্ত শাস্ত্রীয় বচনের সাহায্যেই ছিন্ন করলেন এই মহাপণ্ডিত । যুক্তির সঙ্গে সঙ্গে আনলেন গভীর আবেদন মানুষের বিবেক বুদ্ধি ও মানবিকতার কাছে । প্রতিপক্ষের কাছে । প্রশ্ন রাখলেন— বিধবার বিয়ে দিলে.অধর্ম হয় আর ব্যাভিচার , গর্ভপাত , ভ্রুণহত্যা , নারীহত্যা এগুলি বুঝি খুব বড়াে ধর্মের কাজ ? 

      যুক্তিতে হেরে গিয়ে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠল ধর্মধ্বজী হিন্দুরা । মারমুখী হয়ে উঠল তারা । যুক্তির জোরে না পেরে গায়ের জোরে নিবৃত্ত করতে চাইল বিদ্যাসাগরকে । পথে বের হলেই যখন তখন পণ্ডিতের দল ঘেরাও করে তাকে । কটু কথা বলে । অশ্লীল মন্তব্য করে । হঠাৎ হঠাৎ আড়াল থেকে ছুটে আসে ইট , পাটকেল ও বড়াে বড়াে পাথরের টুকরাে তার মাথা লক্ষ্য করে । কখনাে সামান্যের জন্য বেঁচে যান , কখনাে বা রক্তাক্ত শরীরে বাসায় ফিরে আসতে হয় । 

      বিদ্যাসাগর দেখলেন এভাবে হবে না , মানুষকে বােঝাতে হবে । তাই তিনি প্রায় প্রতিদিন সময় করে শহরের বিখ্যাত ধনী ও মানী গৃহস্থদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বাড়ির কর্তাদের বােঝাতে লাগলেন । তাই শুনে শাস্ত্রজ্ঞান হীন আচারসর্বস্ত হিন্দু অভিজাত সন্তানরা তাকে ব্যঙ্গবিদ্রুপ করতে লাগল । আড়ালে বলতে লাগল সাহেবের পা চাটা বামুন । সাহেব প্রভুকে খুশি করার জন্যে স্বজাতির জাত মারতে চায় । 

     এমনকি ‘ সংবাদ প্রভাকর ’ নামের তৎকালীন বিখ্যাত খবরের কাগজের সম্পাদক কবি ঈশ্বর গুপ্ত ব্যঙ্গ করে ছড়া লিখলেন- ‘ করিয়াছে দলাদলি লাগিয়াছে গােল / বিধবার বিয়ে হবে বাজিয়াছে ঢােল । শহরের সমস্ত ধনী ও ব্রাহ্মণ পণ্ডিত শােভাবাজারের রাজা রাধাকান্ত দেবকে নেতা করে বিদ্যাসাগরের তীব্র বিরােধিতা শুরু করলেন । তারা এমনকি বিদ্যাসাগরকে হত্যা করবার ষড়যন্ত্র পর্যন্ত করলেন । বীরসিংহ গ্রামের বাড়িতে বসে ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় জানতে পারলেন ছেলের প্রাণহানির আশঙ্কার কথা । তিনি তার বিশ্বস্ত লাঠিয়াল শ্ৰীমন্তকে পাঠিয়ে দিলেন কোলকাতায় ঈশ্বরের সর্বক্ষণের সঙ্গী করে ।

       প্রভু বিরক্তি প্রকাশ করা সত্ত্বেও শ্ৰীমন্ত সর্বদা বিদ্যাসাগরকে ছায়ার মতাে অনুসরণ করত । সম্ভবত শুধুমাত্র এই কারণেই বিদ্যাসাগরকে আততায়ীর হাতে প্রাণ দিতে হয়নি । বাঙালি জাতি দারুণ এক লজ্জার হাত থেকে বেঁচেছে । সে যাই হােক , বিদ্যাসাগর কিন্তু প্রাণভয়ে পিছিয়ে আসার পাত্র নন । তিনি রাধাকান্ত দেবকে অনুরােধ করলেন বিধবা বিবাহ বিষয়ে তর্কযুদ্ধ হােক । 

      রাধাকান্ত দেব আয়ােজন করলেন বিরাট তর্কযুদ্ধের । নবদ্বীপ থেকে আনানাে হল শাস্ত্রবিদ পরম পণ্ডিত ব্রজনাথ বিদ্যারত্নকে । অন্যদিকে বিদ্যাসাগর । সামনে হাজার হাজার মানুষের জনতা । 

    বিদ্যাসাগরের তুখােড় যুক্তিজালের কাছে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল বিদ্যারত্নের সমস্ত শাস্ত্রীয় প্রতিরােধ । কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হল না । রাধাকান্ত দেব দুপক্ষকেই শাল দিয়ে সম্মানিত করে সিদ্ধান্ত বিষয়ে নীরব রইলেন । 

     বিদ্যাসাগর চেয়েছিলেন রাজার দিক থেকে সমর্থন আসুক । তাহলেই জনসাধারণ তা মেনে নেবে । কিন্তু না , তা কিছুতেই যে হবার নয় তা হাড়ে হাড়ে তিনি বুঝতে পারলেন । কিন্তু হাল ছাড়লেন না । এবার বিদ্যাসাগর ঠিক করলেন বিধবা বিবাহ প্রচলনের জন্যে আইন পাশ করতে হবে । রাজা রামমােহন যেমন আইন পাশ করিয়ে তবে সতীদাহ প্রথা বন্ধ করতে পেরেছিলেন , তেমনি বিধবা বিবাহকেও ইংরেজের আইনের সাহায্যে প্রচলন করতে হবে । হিন্দু কলেজের ছাত্র ইয়ং বেঙ্গল গােষ্ঠী এবং ব্রাহ্মরাও চাইল বিধবা বিবাহ আইনসিদ্ধ করার জন্যে সরকারের কাছে আবেদন করা হােক ।

       রচনা করা হল আবেদনপাত্র । এবার চাই বিশিষ্ট নাগরিকদের স্বাক্ষর সংগ্রহ । স্বয়ং বিদ্যাসাগর সহ মােট নয়শাে বত্রিশ জনের সই সংগৃহীত হলাে । 

     এবার প্রকাশ্য ভাবে রাধাকান্ত দেব বিরােধিতা শুরু করলেন । তার পক্ষের লােকও নেমে পড়ল বিধবা বিবাহের বিপক্ষে সই সংগ্রহ অভিযানে । সংগৃহীত হলাে তেত্রিশ হাজার সই । অন্যদিকে আবার পথেঘাটে যখন তখন ধনীদের পাঠানাে গুণ্ডারা আক্রমণ করতে লাগল বিদ্যাসাগরকে । 

     শােনা যায় একদিন নাকি জগমােহন সরকার নামে এক বিশিষ্ট ধনীর সামনে গিয়ে তিনি বলেছিলেন আমাকে মারতে আপনি গুগুণ্ডা পাঠিয়েছেন । কেন কষ্ট করে ? এইতাে আমি নিজেই এসেছি । নিন মারুন দেখি । 

      এদিকে রাজ সরকারের কাছে পাঠানাে হয়েছে পক্ষে বিপক্ষে সংগ্রহ করা সই সহ দুটি আবেদনপত্র । সরকার দেখলেন বিধবা বিবাহের পক্ষে সই হাজারেরও কম অন্যদিকে বিপক্ষে স্বাক্ষর করেছেন তেত্রিশ হাজারেরও বেশি লােক । বিদ্যাসাগর ভাবলেন এরপর আর রাজশক্তি নিশ্চয়ই এ ব্যাপারে কোনাে হস্তক্ষেপ করবে না । বিধবাদের দুর্ভাগ্য দূর হবে না । কিন্তু শেষপর্যন্ত জয় হলাে তারই । মানবিকতার বিচারে ইংরেজ রাজশক্তি বিধবার পুনর্বিবাহ আইনসিদ্ধ বলে ঘােষণা করলেন । এমনকি দ্বিতীয়বার বিয়ে করা মহিলার সন্তান ও তার পৈত্রিক সম্পত্তির অধিকার পাবে ' বলে ঘােষিত হলাে । 

      আইন তাে হলাে কিন্তু মানছে কে ? 

     জাতিচ্যুত হবার ভয়ে কোনাে বাবাই তার বিধবা কন্যার বিয়ে দিতে এগিয়ে এলেন না । 

     এবার বিদ্যাসাগর দেখলেন আইন পাশ করা সত্ত্বেও বাস্তবে যদি বিধবাবিবাহ আনুষ্ঠানিক ভাবে সম্পন্ন না হয় তবে সে আইন শুধুমাত্র কাগুজে বাঘ হয়েই থাকবে । চাই বাস্তবের বিধবা বিবাহ । তিনি ঘােষণা করলেন যে যুবক বিধবাকে বিবাহ করবে তাঁর বিয়ের যাবতীয় খরচ তিনি দেবেন । 

      উদার হৃদয় , সরল বিদ্যাসাগরের এই ঘােষণার ফলে কতাে যে ঠগ জোচ্চোর তাকে ঠকিয়ে অর্থ নিয়ে গেছে তার আর লেখা জোখা নেই । যাত্রাদল থেকে মেয়ে ভাড়া করে এনে তাকে বিধবা সাজিয়ে নকল বিয়েবাড়ির আয়ােজন করে মুঠো মুঠো টাকা নিয়েছে লােকে বিদ্যাসাগরকে ঠকিয়ে । যখন জানতে পেরেছেন তখন ঘৃণায় আর ক্রোধে বাক্যহীন হয়ে গেছেন তবু হাল ছাড়েননি বিদ্যাসাগর । 

     এমনও অনেক ক্ষেত্রে ঘটেছে , কুলীন ভদ্রলােক , বাড়িতে বেশ কয়েকজন স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও বিদ্যাসাগরকে দেখিয়ে একজন বিধবাকে বিয়ে করেছে , তারপর তার কাছ থেকে প্রচুর টাকাপয়সা হাতিয়ে নিয়ে বিধবা বালিকাটিকে একা ফেলে রেখে পালিয়ে গেছে । অনেকে আবার তার টাকার লােভে কোনাে অসহায় বিধবাকে বিয়ে করে কার্যত তাকে বাড়ির ঝি কিংবা উপপত্নী হিসাবে ব্যবহার করেছে । 

      এইসব প্রবঞ্চিতা বিধবারা আবার বিদ্যাসাগরকেই গালিগালাজ করেছেন , অভিসম্পাৎ দিয়েছেন । ঈশ্বরের কাছে তাঁর সর্বনাশ ভিক্ষা করেছেন । যাদের সুখের জন্য বিদ্যাসাগর ধন , মান , প্রাণ সমস্ত বাজী । রেখে লড়াই করে গেছেন দিনের পর দিন , তাদেরই মুখে অভিসম্পাত শুনতে শুনতে বিদ্যাসাগরের অন্তরে নিশ্চয়ই চূড়ান্ত নৈরাশ্য আর । বিতৃষ্ণা জেগেছিল । কিন্তু লড়ায়ের মাঠ ছেড়ে একটি দিনের জন্যও তিনি সরে দাঁড়ান নি , হাল ছাড়েন নি ।

       এইসময় বিদ্যাসাগরকে যে কী অবিশ্বাস্য পরিশ্রম করতে হয়েছিল তা বললেও বিশ্বাস করবে না তােমরা । সারাদিন সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন । কলেজ ছুটির পর শহরের অভিজাতদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে ঘুরে তাদের বােঝান । গভীর রাত্রে ঘরে ফিরে পুস্তক রচনা ও শাস্ত্র গ্রন্থ অধ্যয়ন । শাস্ত্রীয় সমর্থন খুঁজতে খুঁজতে কোনাে কোনােদিন রাত প্রায় শেষ হয়ে যেতাে । নিজে ৫০০ টাকা মাইনে পেতেন কিন্তু কিছুই প্রায় সঞ্চয় করতে পারতেন না । বিধবা বিয়ের খরচ মেটাতে গিয়ে বরং সে সময় বেশ কিছু ঋণ হয়ে গিয়েছিল তার । 

      ইয়ং বেঙ্গল গােষ্ঠীর যুবকরা বিদ্যাসাগরকে আশ্বাস দিয়েছিল একবার আইন পাশ হয়ে গেলেই দলে দলে বিধবা বিবাহের ব্যবস্থা করবে তারা । কিন্তু কার্যত দেখা গেল একটিও বিধবার বিয়ে দিতে পারল না তারা । 

      জজ কোর্টের পণ্ডিত , শ্রীশচন্দ্র ন্যায়রত্ন নামের এক তেজস্বী ও আদর্শবান যুবক এই সময় এগিয়ে এল বিধবা বিবাহের প্রতিজ্ঞা নিয়ে । পাত্রীও স্থির হল । শান্তিপুরের এক কুলীন কন্যা নাম কালীমতী , বয়স এগারাে । বিয়ের সব ঠিকঠাক । নিমন্ত্রণপত্র পর্যন্ত ছাপানাে হয়ে গেছে । এমনি সময় হঠাৎ গা ঢাকা দিল শ্রীশচন্দ্র । তার মা নাকি ছেলে বিধবা বিয়ে করলেই আত্মহত্যা করবেন এই বলে শাসিয়েছেন । মায়ের ভয়েই শিক্ষিত যুবক পুত্র নিজের আদর্শ ও কর্তব্য থেকে পিছিয়ে এসে কাপুরুষের মতাে আত্মগােপন করল । সবাই তাকে ছি ছি করতে লাগল । বিদ্যাসাগরের বিরুদ্ধে বিদ্রপ ও ব্যঙ্গের বাণ বর্ষিত হতে লাগল । মুষলধারে । কালীমতীর মা লক্ষ্মীমণি ৪০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে বিদ্যাসাগরের নামে মানহানির মামলা দায়ের করল আদালতে । 

        প্রচণ্ড মানসিক আঘাতে শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন বিদ্যাসাগর । ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের দল কীর্তনীয়া ভাড়া করে পাঠালাে । তারা দিনরাত বিদ্যাসাগরের সুকিয়া স্ট্রিটের বাসায় , তার শােবার ঘরে জানলার কাছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নেচে নেচে গাইতে লাগলেন- ‘ শুয়ে থাকো বিদ্যেসাগর চিররােগী হয়ে । বিদ্যাসাগরের গুণমুগ্ধ শান্তীপুরের তাতীরা সেইসময় শাড়ির পাড়ে সােনালি সুতাে দিয়ে লিখেছিল ‘ বেঁচে থাকো বিদ্যেসাগর চিরজীবী হয়ে’– এ গান তারই প্যারােডি । 

      বিদ্যাসাগর বিছানায় শুয়ে শুয়ে নীরবে শুনতেন ওই প্যারডি । বন্ধু রাজকৃষ্ণ জানালা বন্ধ করে দিতে চাইলে তিনি বাধা দিয়ে বলতেন ওরা ভাড়া করা লােক । কাজ না করলে টাকা পাবে না । হয়তাে তিনি ওই প্যারােডির মধ্যে থেকেই খুঁজে নিতেন তার ভবিষ্যৎ সংগ্রামের শক্তি । 

      এদিকে শ্রীশচন্দ্রের ভীরুতায় উৎসাহিত হয়ে রাধাকান্ত দেবের দলবল আবার নতুন এক আবেদনপত্র পাঠালাে সরকারের কাছে । আবেদনে লেখা হল যে আইন করবার পরও যখন একটি ও বিধবার বিয়ে দেওয়া গেল না তখন এ আইন রদ করে দেওয়া হােক না হলে সরকারই হাস্যাস্পদ হবেন । 

       এ খবরও যথাসময়ে বিদ্যাসাগরের কানে পৌছুল । তিনি বুঝলেন সর্বাংশে পরাজয় ঘটতে চলেছে । তবু ভেঙে না পড়ে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে লাগলেন । মানুষের শুভবুদ্ধির উদয়ের জন্য এই অপেক্ষা কিন্তু শেষপর্যন্ত হতাশ করল না তাঁকে । 

      শ্ৰীশচন্দ্র নিজের দুর্বলতা কাটিয়ে উঠে বিদ্যাসাগরের পায়ে লুটিয়ে পড়ল । সে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে । মাকেও বুঝিয়ে রাজি করিয়েছে । কালীমতীর মা লক্ষ্মীমণি ও আদালত থেকে মানহানির মামলা । তুলে নিয়েছেন ।

      কাজেই শুভবিবাহের পথে আর কোনাে বাধা রইল না । রােগশয্যায় উঠে বসলেন বিদ্যাসাগর । তার দেহে মনে আবার ফিরে এলাে সিংহের শক্তি । সুকিয়া স্ট্রিটে বিদ্যাসাগরের বাড়িতেই সামিয়ানা খাটিয়ে ২০০০ লােক নিমন্ত্রণ করে মহা ধুমধাম সহকারে অনুষ্ঠিত হল কলকাতার প্রথম বিধবা বিবাহ । একজন শিক্ষিত প্রতিষ্ঠিত অবিবাহিত , কুলীন হিন্দু ব্রাহ্মণ যুবক স্বেচ্ছায় ও সাড়ম্বরে এক বিধবা বালিকাকে বিয়ে করে সংসারে বরণ করে নিল । বহু সম্ভ্রান্ত নারীপুরুষ বিবাহে উপস্থিত হয়ে বর কনেকে আশীর্বাদ করল । আইনত সিদ্ধ বিধবা বিবাহ এবার সমাজেও সিদ্ধ হল । 

      এতদিনে জয় হল বিদ্যাসাগরের । জয় হল তার অজেয় পুরুষকারের । এরপর থেকে আর কোনাে বাধা রইল না । একে একে কোলকাতার অনেক কুলীন অভিভাবকই তাঁদের বিধবা কন্যাদের বিয়ে দিতে এগিয়ে এলেন । 

       অবশ্য শ্রীশচন্দ্রের বিয়ে পণ্ড করে দেবার জন্যে রাজা রাধাকান্ত দেবের দলবল চেষ্টার কোনাে ত্রুটি করেনি । বােমা , পটকা ও লাঠিয়াল নিয়ে বরের শােভাযাত্রার ওপর হামলা চালাবার জন্য সবরকম চেষ্টাই করেছিল তারা । কিন্তু আগে থেকেই প্রচুর পুলিশ মােতায়েন রাখায় তাদের চেষ্টা ব্যর্থ হল ।

      জগতে শুভশক্তির জয় হবেই হবে । জয়যুক্ত হবেই কল্যাণমুখী মানুষের আপ্রাণ সংগ্রাম । হয়তাে বিলম্ব হবে , কিন্তু জয় হবেই । 

       ‘ যদি ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলাে রে ' -রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

সমাপ্ত 

 

0 Comments: