বিদ্যাসাগর
সাগরে যে অগ্নি থাকে
কল্পনা সে নয়
তােমায় দেখে বিশ্ববাসীর
হয়েছে প্রত্যয়
মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামের এক মাটির ঘরে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যখন জন্মালেন তখন তাঁর বাবা ঠাকুরদাস বাড়িতে ছিলেন । সন্ধ্যাবেলা তিনি যখন বাড়িতে ফিরলেন তখন তার ঠাকুরদাদা জয়রাম তর্করত্ন ছেলেকে ডেকে বললেন , ‘ ওরে আজ একটা এঁড়ে বাছুর হয়েছে । কথাটি তিনি মজা করেই বলেছিলেন- পুত্রসন্তানের জন্ম হয়েছে বােঝাতে । কিন্তু আশ্চর্যরকমভাবে অন্যদিক দিয়ে কথাটা সত্য হয়ে গেল । এঁড়ে বাছুররা ভীষণ একগুঁয়ে হয় । যা জেদ করে ঠিক তাই করে । আমাদের বিদ্যাসাগর , যাঁকে নিয়ে বাঙালির আজ এতাে গর্ব , তিনিও ঠিক এমনি এঁড়ে বাছুরের মতাে একগুয়ে ছিলেন । যা করবেন ভাবতেন তার থেকে তাকে একচুলও নাড়ানাে যেত না । শান্ত সুবােধ বালক বলতে যা বােঝায় তিনি ছিলেন ঠিক তার উল্টো ।
বাবা যেই বলতেন— ঈশ্বর , নাও স্নান করে নাও । ঈশ্বর অমনি গো ধরে বসতেন না , আজ আমি কিছুতেই স্নান করব না । তার বাবা বলতেন— বাবা ঈশ্বর , জামাকাপড় পরে পাঠশালায় যাও । অমনি ঈশ্বর গোঁ ধরে বসতেন— না , পাঠশালায় যাব না আজ । যাব না তাে যাবই । অনুরােধ , উপরােধ , প্রহার , ভয় কোনাে কিছুতেই তাকে টলাতে পারতাে না । নিজের সংকল্পে পাহাড়ের মতাে অনড় হয়ে থাকতেন তিনি । বাধ্য হয়ে তার বাবা এক উপায় বার করলেন ।
তিনি স্কুলের বেলা হলে ছেলেকে ডেকে বলতেন— ঈশ্বর , আজ যেন স্নান করাে না । আর স্কুলে গিয়েও কাজ নেই ।
ম্যাজিকের মতাে কাজ করতে দাওয়াই । ঈশ্বর চটপট স্নান খাওয়া সেরে লক্ষ্মী ছেলে হয়ে বইপত্র নিয়ে স্কুলে চলে যেতেন ।
এইরকম ভীষণ জেদী ছিলেন বলেই দরিদ্র এক পাড়াগেঁয়ে বালক বিদ্যাসাগর হতে পেরেছিলেন । তেলের অভাবে বাসায় আলাে জ্বলত না । রাস্তার গ্যাসের আলাের নীচে দাঁড়িয়ে পড়তেন তিনি । মেসে থাকতেন । থাকা খাওয়ার বিনিময়ে রান্না করা , বাসনমাজা , বাজার করা এসব করেও তিনি প্রত্যেকটি পরীক্ষায় প্রথম হতেন । পরবর্তী জীবনে তিনি সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ হন , ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের প্রিন্সিপাল এবং সারা দেশের সব স্কুলের ইন্সপেক্টরও হয়েছিলেন তিনি । এই দুর্দমনীয় গোঁ আর স্রোতের বিপরীতে টর্পেডাের মতাে দৌড়ে চলার প্রবণতা সারাজীবন কাজ করে গেছে বিদ্যাসাগরের মধ্যে । কখনাে কোনাে অন্যায়ের কাছে নতিস্বীকার করেন নি । যে কাজ শুরু করেছেন , সহস্র বাধা সত্ত্বেও তা সম্পূর্ণভাবে সমাপ্ত না করা পর্যন্ত এক চুল সরে দাঁড়ান নি সে কাজ থেকে ।
জলের মতাে অর্থব্যয় হয়েছে , প্রাণ পর্যন্ত বিপন্ন হয়েছে । ঘরে বাইরে সবাই শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে , অতি বিশ্বস্ত স্বজনও গােপনে ষড়যন্ত্রকারীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে । তবু নিজের অভীষ্ট লক্ষ্যে স্থির থেকেছেন বিদ্যাসাগর । ক্ষুব্ধ হয়েছেন , হতাশ হয়েছেন , হাল ছাড়েন নি তবু । সমস্ত ক্লান্তি আর হতাশা নিজের মনের জোরেই ঝেড়ে ফেলে আবার ঝাপিয়ে পড়েছেন সংগ্রামে ।
তার জীবনের অজস্র ঘটনার মধ্যে একটা ঘটনার কথা বলি ।
বাংলাদেশের বাল্যবিধবাদের অবর্ণনীয় কষ্ট দেখে দয়ার সাগর প্রতিজ্ঞা করলেন যেমন করেই হােক এদের দুঃখ দূর করতে হবে । কিন্তু আচারসর্বস্ব গোঁড়া হিন্দুদের ঘরে , বিশেষ করে কুলীন ব্রাহ্মণদের পরিবারে বিধবাদের কষ্ট দূর করার মতাে কোনাে পথই নেই । কৌলীন্য ধর্মরক্ষার জন্য ছােটোছােটো বালিকাদের বিয়ে দেওয়া হতাে বৃদ্ধ বরের সঙ্গে । তারা মারা গেলে শিশুকন্যাটি বিধবা হত আর তারপর আজীবন । তাকে পালন করতে হত সুকঠোর ব্রহ্মচর্য । একবেলা নিরামিষ ভাত খেতে পেত সে । একাদশীর দিন নির্জলা উপােষ । যদি কোনাে বালিকা । বিধবা তৃষ্ণায় কাতর হয়ে একফোটা জল পান করে ফেলত তবে তার পিতৃকূলকে সমাজচ্যুত হতে হত । তার ওপর পতি পুত্রহীনা বালিকা বিধবাকে দিয়ে সংসারের সব কাজ করানাে হত দাসীর মতাে । তার জীবনে সাধ আহাদ বলতে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকত না । এতাে অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে অনেক বালিকা বিধবা আত্মহত্যা করতাে , অনেকে বাড়ি থেকে পালিয়ে হারিয়ে যেত সমাজের অন্ধকার গহ্বরে । অনেকে করত দাসীবৃত্তি । অসংখ্য হিন্দুবিধবা কাশীতে গিয়ে বিশ্বনাথ মন্দিরের পথে ভিক্ষা করে প্রাণধারণ করতেন ।
বিদ্যাসাগর ঠিক করলেন বিধবাদের আবার বিবাহ দিতে হবে । তার এই প্রস্তাবের কথা শুনে রক্ষণশীল ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরা ছি ছি করে উঠলেন । তারা সমস্বরে চিৎকার করে বলতে লাগলেন , এ অন্যায় । অশাস্ত্রীয় । এরকম করলে মহাপাপ হবে । হিন্দুধর্ম ধ্বংস হয়ে যাবে ।
শিক্ষিত অশিক্ষিত , ধনী , নির্ধন সবার মুখে একই কথা শুনে হতাশ হলেন বিদ্যাসাগর- কিন্তু হাল ছাড়লেন না । রাশি রাশি সংস্কৃত শাস্ত্রগ্রন্থ ঘেঁটে দিনরাত তন্নতন্ন করে খুঁজে বেড়াতে লাগলেন বিধবাদের সপক্ষে কোথাও কোনাে উক্তি আছে কিনা । পেয়েও গেলেন । সমস্ত যুক্তিতর্কের শানিত অস্ত্র দিয়ে সাজিয়ে তিনি একটি পুস্তিকা প্রকাশ করলেন |
' বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদবিষয়ক প্রস্তাব ' নামে বইটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে চারিদিকে তর্ক বির্তকের ঝড় উঠল । দলে দলে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরা কলম ধরলেন বিদ্যাসাগরের বিপক্ষে । কিন্তু বিদ্যাসাগরও দমবার পাত্র নন । বিরােধীদের সমস্ত যুক্তিজাল উপযুক্ত শাস্ত্রীয় বচনের সাহায্যেই ছিন্ন করলেন এই মহাপণ্ডিত । যুক্তির সঙ্গে সঙ্গে আনলেন গভীর আবেদন মানুষের বিবেক বুদ্ধি ও মানবিকতার কাছে । প্রতিপক্ষের কাছে । প্রশ্ন রাখলেন— বিধবার বিয়ে দিলে.অধর্ম হয় আর ব্যাভিচার , গর্ভপাত , ভ্রুণহত্যা , নারীহত্যা এগুলি বুঝি খুব বড়াে ধর্মের কাজ ?
যুক্তিতে হেরে গিয়ে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠল ধর্মধ্বজী হিন্দুরা । মারমুখী হয়ে উঠল তারা । যুক্তির জোরে না পেরে গায়ের জোরে নিবৃত্ত করতে চাইল বিদ্যাসাগরকে । পথে বের হলেই যখন তখন পণ্ডিতের দল ঘেরাও করে তাকে । কটু কথা বলে । অশ্লীল মন্তব্য করে । হঠাৎ হঠাৎ আড়াল থেকে ছুটে আসে ইট , পাটকেল ও বড়াে বড়াে পাথরের টুকরাে তার মাথা লক্ষ্য করে । কখনাে সামান্যের জন্য বেঁচে যান , কখনাে বা রক্তাক্ত শরীরে বাসায় ফিরে আসতে হয় ।
বিদ্যাসাগর দেখলেন এভাবে হবে না , মানুষকে বােঝাতে হবে । তাই তিনি প্রায় প্রতিদিন সময় করে শহরের বিখ্যাত ধনী ও মানী গৃহস্থদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বাড়ির কর্তাদের বােঝাতে লাগলেন । তাই শুনে শাস্ত্রজ্ঞান হীন আচারসর্বস্ত হিন্দু অভিজাত সন্তানরা তাকে ব্যঙ্গবিদ্রুপ করতে লাগল । আড়ালে বলতে লাগল সাহেবের পা চাটা বামুন । সাহেব প্রভুকে খুশি করার জন্যে স্বজাতির জাত মারতে চায় ।
এমনকি ‘ সংবাদ প্রভাকর ’ নামের তৎকালীন বিখ্যাত খবরের কাগজের সম্পাদক কবি ঈশ্বর গুপ্ত ব্যঙ্গ করে ছড়া লিখলেন- ‘ করিয়াছে দলাদলি লাগিয়াছে গােল / বিধবার বিয়ে হবে বাজিয়াছে ঢােল । শহরের সমস্ত ধনী ও ব্রাহ্মণ পণ্ডিত শােভাবাজারের রাজা রাধাকান্ত দেবকে নেতা করে বিদ্যাসাগরের তীব্র বিরােধিতা শুরু করলেন । তারা এমনকি বিদ্যাসাগরকে হত্যা করবার ষড়যন্ত্র পর্যন্ত করলেন । বীরসিংহ গ্রামের বাড়িতে বসে ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় জানতে পারলেন ছেলের প্রাণহানির আশঙ্কার কথা । তিনি তার বিশ্বস্ত লাঠিয়াল শ্ৰীমন্তকে পাঠিয়ে দিলেন কোলকাতায় ঈশ্বরের সর্বক্ষণের সঙ্গী করে ।
প্রভু বিরক্তি প্রকাশ করা সত্ত্বেও শ্ৰীমন্ত সর্বদা বিদ্যাসাগরকে ছায়ার মতাে অনুসরণ করত । সম্ভবত শুধুমাত্র এই কারণেই বিদ্যাসাগরকে আততায়ীর হাতে প্রাণ দিতে হয়নি । বাঙালি জাতি দারুণ এক লজ্জার হাত থেকে বেঁচেছে । সে যাই হােক , বিদ্যাসাগর কিন্তু প্রাণভয়ে পিছিয়ে আসার পাত্র নন । তিনি রাধাকান্ত দেবকে অনুরােধ করলেন বিধবা বিবাহ বিষয়ে তর্কযুদ্ধ হােক ।
রাধাকান্ত দেব আয়ােজন করলেন বিরাট তর্কযুদ্ধের । নবদ্বীপ থেকে আনানাে হল শাস্ত্রবিদ পরম পণ্ডিত ব্রজনাথ বিদ্যারত্নকে । অন্যদিকে বিদ্যাসাগর । সামনে হাজার হাজার মানুষের জনতা ।
বিদ্যাসাগরের তুখােড় যুক্তিজালের কাছে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল বিদ্যারত্নের সমস্ত শাস্ত্রীয় প্রতিরােধ । কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হল না । রাধাকান্ত দেব দুপক্ষকেই শাল দিয়ে সম্মানিত করে সিদ্ধান্ত বিষয়ে নীরব রইলেন ।
বিদ্যাসাগর চেয়েছিলেন রাজার দিক থেকে সমর্থন আসুক । তাহলেই জনসাধারণ তা মেনে নেবে । কিন্তু না , তা কিছুতেই যে হবার নয় তা হাড়ে হাড়ে তিনি বুঝতে পারলেন । কিন্তু হাল ছাড়লেন না । এবার বিদ্যাসাগর ঠিক করলেন বিধবা বিবাহ প্রচলনের জন্যে আইন পাশ করতে হবে । রাজা রামমােহন যেমন আইন পাশ করিয়ে তবে সতীদাহ প্রথা বন্ধ করতে পেরেছিলেন , তেমনি বিধবা বিবাহকেও ইংরেজের আইনের সাহায্যে প্রচলন করতে হবে । হিন্দু কলেজের ছাত্র ইয়ং বেঙ্গল গােষ্ঠী এবং ব্রাহ্মরাও চাইল বিধবা বিবাহ আইনসিদ্ধ করার জন্যে সরকারের কাছে আবেদন করা হােক ।
রচনা করা হল আবেদনপাত্র । এবার চাই বিশিষ্ট নাগরিকদের স্বাক্ষর সংগ্রহ । স্বয়ং বিদ্যাসাগর সহ মােট নয়শাে বত্রিশ জনের সই সংগৃহীত হলাে ।
এবার প্রকাশ্য ভাবে রাধাকান্ত দেব বিরােধিতা শুরু করলেন । তার পক্ষের লােকও নেমে পড়ল বিধবা বিবাহের বিপক্ষে সই সংগ্রহ অভিযানে । সংগৃহীত হলাে তেত্রিশ হাজার সই । অন্যদিকে আবার পথেঘাটে যখন তখন ধনীদের পাঠানাে গুণ্ডারা আক্রমণ করতে লাগল বিদ্যাসাগরকে ।
শােনা যায় একদিন নাকি জগমােহন সরকার নামে এক বিশিষ্ট ধনীর সামনে গিয়ে তিনি বলেছিলেন আমাকে মারতে আপনি গুগুণ্ডা পাঠিয়েছেন । কেন কষ্ট করে ? এইতাে আমি নিজেই এসেছি । নিন মারুন দেখি ।
এদিকে রাজ সরকারের কাছে পাঠানাে হয়েছে পক্ষে বিপক্ষে সংগ্রহ করা সই সহ দুটি আবেদনপত্র । সরকার দেখলেন বিধবা বিবাহের পক্ষে সই হাজারেরও কম অন্যদিকে বিপক্ষে স্বাক্ষর করেছেন তেত্রিশ হাজারেরও বেশি লােক । বিদ্যাসাগর ভাবলেন এরপর আর রাজশক্তি নিশ্চয়ই এ ব্যাপারে কোনাে হস্তক্ষেপ করবে না । বিধবাদের দুর্ভাগ্য দূর হবে না । কিন্তু শেষপর্যন্ত জয় হলাে তারই । মানবিকতার বিচারে ইংরেজ রাজশক্তি বিধবার পুনর্বিবাহ আইনসিদ্ধ বলে ঘােষণা করলেন । এমনকি দ্বিতীয়বার বিয়ে করা মহিলার সন্তান ও তার পৈত্রিক সম্পত্তির অধিকার পাবে ' বলে ঘােষিত হলাে ।
আইন তাে হলাে কিন্তু মানছে কে ?
জাতিচ্যুত হবার ভয়ে কোনাে বাবাই তার বিধবা কন্যার বিয়ে দিতে এগিয়ে এলেন না ।
এবার বিদ্যাসাগর দেখলেন আইন পাশ করা সত্ত্বেও বাস্তবে যদি বিধবাবিবাহ আনুষ্ঠানিক ভাবে সম্পন্ন না হয় তবে সে আইন শুধুমাত্র কাগুজে বাঘ হয়েই থাকবে । চাই বাস্তবের বিধবা বিবাহ । তিনি ঘােষণা করলেন যে যুবক বিধবাকে বিবাহ করবে তাঁর বিয়ের যাবতীয় খরচ তিনি দেবেন ।
উদার হৃদয় , সরল বিদ্যাসাগরের এই ঘােষণার ফলে কতাে যে ঠগ জোচ্চোর তাকে ঠকিয়ে অর্থ নিয়ে গেছে তার আর লেখা জোখা নেই । যাত্রাদল থেকে মেয়ে ভাড়া করে এনে তাকে বিধবা সাজিয়ে নকল বিয়েবাড়ির আয়ােজন করে মুঠো মুঠো টাকা নিয়েছে লােকে বিদ্যাসাগরকে ঠকিয়ে । যখন জানতে পেরেছেন তখন ঘৃণায় আর ক্রোধে বাক্যহীন হয়ে গেছেন তবু হাল ছাড়েননি বিদ্যাসাগর ।
এমনও অনেক ক্ষেত্রে ঘটেছে , কুলীন ভদ্রলােক , বাড়িতে বেশ কয়েকজন স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও বিদ্যাসাগরকে দেখিয়ে একজন বিধবাকে বিয়ে করেছে , তারপর তার কাছ থেকে প্রচুর টাকাপয়সা হাতিয়ে নিয়ে বিধবা বালিকাটিকে একা ফেলে রেখে পালিয়ে গেছে । অনেকে আবার তার টাকার লােভে কোনাে অসহায় বিধবাকে বিয়ে করে কার্যত তাকে বাড়ির ঝি কিংবা উপপত্নী হিসাবে ব্যবহার করেছে ।
এইসব প্রবঞ্চিতা বিধবারা আবার বিদ্যাসাগরকেই গালিগালাজ করেছেন , অভিসম্পাৎ দিয়েছেন । ঈশ্বরের কাছে তাঁর সর্বনাশ ভিক্ষা করেছেন । যাদের সুখের জন্য বিদ্যাসাগর ধন , মান , প্রাণ সমস্ত বাজী । রেখে লড়াই করে গেছেন দিনের পর দিন , তাদেরই মুখে অভিসম্পাত শুনতে শুনতে বিদ্যাসাগরের অন্তরে নিশ্চয়ই চূড়ান্ত নৈরাশ্য আর । বিতৃষ্ণা জেগেছিল । কিন্তু লড়ায়ের মাঠ ছেড়ে একটি দিনের জন্যও তিনি সরে দাঁড়ান নি , হাল ছাড়েন নি ।
এইসময় বিদ্যাসাগরকে যে কী অবিশ্বাস্য পরিশ্রম করতে হয়েছিল তা বললেও বিশ্বাস করবে না তােমরা । সারাদিন সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন । কলেজ ছুটির পর শহরের অভিজাতদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে ঘুরে তাদের বােঝান । গভীর রাত্রে ঘরে ফিরে পুস্তক রচনা ও শাস্ত্র গ্রন্থ অধ্যয়ন । শাস্ত্রীয় সমর্থন খুঁজতে খুঁজতে কোনাে কোনােদিন রাত প্রায় শেষ হয়ে যেতাে । নিজে ৫০০ টাকা মাইনে পেতেন কিন্তু কিছুই প্রায় সঞ্চয় করতে পারতেন না । বিধবা বিয়ের খরচ মেটাতে গিয়ে বরং সে সময় বেশ কিছু ঋণ হয়ে গিয়েছিল তার ।
ইয়ং বেঙ্গল গােষ্ঠীর যুবকরা বিদ্যাসাগরকে আশ্বাস দিয়েছিল একবার আইন পাশ হয়ে গেলেই দলে দলে বিধবা বিবাহের ব্যবস্থা করবে তারা । কিন্তু কার্যত দেখা গেল একটিও বিধবার বিয়ে দিতে পারল না তারা ।
জজ কোর্টের পণ্ডিত , শ্রীশচন্দ্র ন্যায়রত্ন নামের এক তেজস্বী ও আদর্শবান যুবক এই সময় এগিয়ে এল বিধবা বিবাহের প্রতিজ্ঞা নিয়ে । পাত্রীও স্থির হল । শান্তিপুরের এক কুলীন কন্যা নাম কালীমতী , বয়স এগারাে । বিয়ের সব ঠিকঠাক । নিমন্ত্রণপত্র পর্যন্ত ছাপানাে হয়ে গেছে । এমনি সময় হঠাৎ গা ঢাকা দিল শ্রীশচন্দ্র । তার মা নাকি ছেলে বিধবা বিয়ে করলেই আত্মহত্যা করবেন এই বলে শাসিয়েছেন । মায়ের ভয়েই শিক্ষিত যুবক পুত্র নিজের আদর্শ ও কর্তব্য থেকে পিছিয়ে এসে কাপুরুষের মতাে আত্মগােপন করল । সবাই তাকে ছি ছি করতে লাগল । বিদ্যাসাগরের বিরুদ্ধে বিদ্রপ ও ব্যঙ্গের বাণ বর্ষিত হতে লাগল । মুষলধারে । কালীমতীর মা লক্ষ্মীমণি ৪০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে বিদ্যাসাগরের নামে মানহানির মামলা দায়ের করল আদালতে ।
প্রচণ্ড মানসিক আঘাতে শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন বিদ্যাসাগর । ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের দল কীর্তনীয়া ভাড়া করে পাঠালাে । তারা দিনরাত বিদ্যাসাগরের সুকিয়া স্ট্রিটের বাসায় , তার শােবার ঘরে জানলার কাছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নেচে নেচে গাইতে লাগলেন- ‘ শুয়ে থাকো বিদ্যেসাগর চিররােগী হয়ে । বিদ্যাসাগরের গুণমুগ্ধ শান্তীপুরের তাতীরা সেইসময় শাড়ির পাড়ে সােনালি সুতাে দিয়ে লিখেছিল ‘ বেঁচে থাকো বিদ্যেসাগর চিরজীবী হয়ে’– এ গান তারই প্যারােডি ।
বিদ্যাসাগর বিছানায় শুয়ে শুয়ে নীরবে শুনতেন ওই প্যারডি । বন্ধু রাজকৃষ্ণ জানালা বন্ধ করে দিতে চাইলে তিনি বাধা দিয়ে বলতেন ওরা ভাড়া করা লােক । কাজ না করলে টাকা পাবে না । হয়তাে তিনি ওই প্যারােডির মধ্যে থেকেই খুঁজে নিতেন তার ভবিষ্যৎ সংগ্রামের শক্তি ।
এদিকে শ্রীশচন্দ্রের ভীরুতায় উৎসাহিত হয়ে রাধাকান্ত দেবের দলবল আবার নতুন এক আবেদনপত্র পাঠালাে সরকারের কাছে । আবেদনে লেখা হল যে আইন করবার পরও যখন একটি ও বিধবার বিয়ে দেওয়া গেল না তখন এ আইন রদ করে দেওয়া হােক না হলে সরকারই হাস্যাস্পদ হবেন ।
এ খবরও যথাসময়ে বিদ্যাসাগরের কানে পৌছুল । তিনি বুঝলেন সর্বাংশে পরাজয় ঘটতে চলেছে । তবু ভেঙে না পড়ে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে লাগলেন । মানুষের শুভবুদ্ধির উদয়ের জন্য এই অপেক্ষা কিন্তু শেষপর্যন্ত হতাশ করল না তাঁকে ।
শ্ৰীশচন্দ্র নিজের দুর্বলতা কাটিয়ে উঠে বিদ্যাসাগরের পায়ে লুটিয়ে পড়ল । সে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে । মাকেও বুঝিয়ে রাজি করিয়েছে । কালীমতীর মা লক্ষ্মীমণি ও আদালত থেকে মানহানির মামলা । তুলে নিয়েছেন ।
কাজেই শুভবিবাহের পথে আর কোনাে বাধা রইল না । রােগশয্যায় উঠে বসলেন বিদ্যাসাগর । তার দেহে মনে আবার ফিরে এলাে সিংহের শক্তি । সুকিয়া স্ট্রিটে বিদ্যাসাগরের বাড়িতেই সামিয়ানা খাটিয়ে ২০০০ লােক নিমন্ত্রণ করে মহা ধুমধাম সহকারে অনুষ্ঠিত হল কলকাতার প্রথম বিধবা বিবাহ । একজন শিক্ষিত প্রতিষ্ঠিত অবিবাহিত , কুলীন হিন্দু ব্রাহ্মণ যুবক স্বেচ্ছায় ও সাড়ম্বরে এক বিধবা বালিকাকে বিয়ে করে সংসারে বরণ করে নিল । বহু সম্ভ্রান্ত নারীপুরুষ বিবাহে উপস্থিত হয়ে বর কনেকে আশীর্বাদ করল । আইনত সিদ্ধ বিধবা বিবাহ এবার সমাজেও সিদ্ধ হল ।
এতদিনে জয় হল বিদ্যাসাগরের । জয় হল তার অজেয় পুরুষকারের । এরপর থেকে আর কোনাে বাধা রইল না । একে একে কোলকাতার অনেক কুলীন অভিভাবকই তাঁদের বিধবা কন্যাদের বিয়ে দিতে এগিয়ে এলেন ।
অবশ্য শ্রীশচন্দ্রের বিয়ে পণ্ড করে দেবার জন্যে রাজা রাধাকান্ত দেবের দলবল চেষ্টার কোনাে ত্রুটি করেনি । বােমা , পটকা ও লাঠিয়াল নিয়ে বরের শােভাযাত্রার ওপর হামলা চালাবার জন্য সবরকম চেষ্টাই করেছিল তারা । কিন্তু আগে থেকেই প্রচুর পুলিশ মােতায়েন রাখায় তাদের চেষ্টা ব্যর্থ হল ।
জগতে শুভশক্তির জয় হবেই হবে । জয়যুক্ত হবেই কল্যাণমুখী মানুষের আপ্রাণ সংগ্রাম । হয়তাে বিলম্ব হবে , কিন্তু জয় হবেই ।
‘ যদি ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলাে রে ' -রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সমাপ্ত
0 Comments: