মেরী কুরী
প্রচণ্ড দারিদ্র্য , অসহনীয় শােক আর অবর্ণনীয় রােগযন্ত্রণাকে পরােয়া করে যে বীরাঙ্গনা নারী পৃথিবীকে চমকে দিয়ে দু দুবার নােবেল পুরস্কার অর্জন করেছিলেন তিনিই মাদাম মারিয়া কুরী । এমন লড়াকু চরিত্রের নারী পৃথিবীর ইতিহাসে আর দুটি আছে কিনা আমি জানি না । জানি না— একাধারে জ্ঞান তপস্যা আর মানবসেবার কাজ এভাবে বিশ্বের আর কেউ কখনাে চালিয়ে গেছেন কিনা ।
১৮৬৭ খ্রি . ৭ নভেম্বর পােল্যান্ডের এক শহরে শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত পরিবারে মাদাম মেরী স্কোলাডােভস্কির জন্ম । বাবা ভ্রাডিস্লাব ক্লেদোভস্কি বিজ্ঞানের শিক্ষক । পরবর্তীকালে বেশ কিছুদিন কলেজে ও বিজ্ঞানের অধ্যাপনা করেন । মা হেডমিসট্রেস । পাঁচ ভাইবােনের জমজমাট পরিবার । প্রতিটি ভাইবােন বুদ্ধিমান । বিশেষ করে সেজো বােন মেরি প্রতিটি বিষয়ে স্কুলে প্রথম । বাবা মা আর দিদিদের বড়াে আদরের মান্না বা মানুসুয়াকে নিয়ে সবাই স্বপ্ন দেখে একদিন অনেক , অনেক বড়াে হবে সে ।
মান্নার যখন ৮ বছর বয়স তখন মারা গেল তার আদরের বড়াে বােন । জোসিয়া । এতাে ছােটো বয়সে জীবনে প্রথম মৃত্যুকে দেখল সে । মা ছিলেন থাইসিস রুগী । মেয়েদের কোলে পিঠে নিয়ে আদর করা , তাদের দেখাশােনা করা— এসব থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতেন । মায়ের অভাবপূরণ করত যে বড়াে দিদি ভগবান তাকেই কেড়ে নিলেন । দিদির শােক ভুলতে না ভুলতে মারা গেলেন মা । মেরীর বয়স তখন মাত্র ১০ । রুগ্ন মা - কে পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ভালােবাসত সে । মায়ের শােক ভুলতে বাবার স্টাডিতে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিত সে । নানা রকমের বই পড়ত মেরী , সেইসঙ্গে মেজদি ব্রোন্নাকেও সাহায্য করত সংসারের নানা কাজে । আবার স্কুলের বেলায় বইপত্র গুছিয়ে স্কুলে চলে যেত মান্না । এভাবেই যােলাে বছর বয়সে স্কুলের শেষ পরীক্ষায় বসল আর সােনার মেডেল নিয়ে পাশও করে গেল মেরী , অনায়াসে ।
কিন্তু এর আগেই সংসারের ওপর নেমে এসেছে আরাে বড়াে অভিশাপ । পােল্যান্ড তখন রাশিয়ার দখলে । কিন্তু স্বদেশভক্ত ক্রোডােভস্কি পরিবার কোনােদিনই রুশ শাসনকে মেনে নিতে পারেনি । আত্মমর্যাদা সম্পন্ন ভদ্রলােক মেরীর বাবা তাই স্কুলের চাকরিটি হঠাৎ খােয়ালেন । স্কুল কলেজ সর্বত্রই তখন রাশিয়ার কড়া খবরদারি । এতােগুলি শিশুর খাওয়া পরা ও শিক্ষা কিভাবে চলবে এ প্রশ্নের কোনাে উত্তর খুঁজে পেলেন না তিনি । বাধ্য হয়ে সােনার মেডেল পাওয়া সােনার মেয়েকেও স্কুল ছাড়তে হল । চলে গেলেন অজ পাড়াগাঁয়ে জনৈক আত্মীয়ের বাড়ি । কিন্তু হতাশায় মুষড়ে পড়লেন । বরং পল্লীবাসের দিনগুলিকে কাজে লাগিয়ে অনায়াসে শিখে নিলেন কেমন করে ঘােড়ায় চড়তে হয় , নৌকা চালাতে হয় । ভাগ্যকে দোষ না । দিয়ে শান্তভাবেই মেনে নিলেন পরিস্থিতির কঠোরতা । কিন্তু বেশিদিন গ্রামে থাকতে পারলেন না মেরী । বাবা আর ভাইবােনদের থেকে দূরে থাকা অনাহারের চেয়েও কঠিন তাঁর কাছে । তাই বাড়ি ফিরে এসে বাড়ি বাড়ি টিউশান শুরু করে দিলেন ।
সতেরাে বছরের সুন্দরী ফুটফুটে মেয়েটি সারাদিন এবাড়ি থেকে ওবাড়ি ছাত্রী পড়িয়ে পড়িয়ে ঘুরছেন । তার মাইনে যেমন সামান্য তেমনি অনিয়মিত । কিছু বলতে গেলেই পত্রপাঠ বিদায় । ধনী গিন্নীরা কততদিন বসিয়ে রেখেছে তাকে অকারণে , কতােদিন অপমান করেছে , করেছে তাচ্ছিল্য । তবু ১৭ বছরের মেয়েটির ধৈর্যচ্যুতি ঘটেনি । এতােকিছুর ফাকে ফাকেও ঠিক চালিয়ে গেছে নিজের পড়াশােনা । সেইসময় পােল্যান্ডে floating university বলে একরকম ভ্রাম্যমান পাঠাগার ছিল । দারিদ্র্য বা অন্য কোনাে কারণে যারা কলেজে পড়তে পারত না তাদের পড়াশােনা চালিয়ে যেতে সবরকম সাহায্য করত এই floating university । মেরীও এই floating university তে পড়তে লাগলেন আর স্বপ্ন দেখতে লাগলেন সােরবেন ইউনিভার্সিটি থেকে বিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষা লাভ করবেন তারপর স্বদেশে ফিরে এসে সেবা করবেন দেশজননীর ।
স্বপ্ন দেখতেন তার মেজদি ব্রোন্নাও । প্যারিসে গিয়ে ডাক্তারি পড়বেন । কিন্তু কোথায় টাকা , কোথায় কি ? অসহায় বাবা আদরের মেয়েদের এই অপূর্ণ স্বপ্নের যন্ত্রণা চোখের ওপর চেয়ে চেয়ে দেখতেন আর অঝােরে কাঁদতেন , বাবা হিসেবে নিজের ব্যর্থতায় ।
- “ বুড়াে বাপকে তােরা ক্ষমা করিস মা ।
দুই মেয়ে আদর করে বাবার চোখ মুছিয়ে দিয়ে বলতেন- দেখাে বাবা , আমরা একদিন ঠিক আমাদের স্বপ্ন সার্থক করব । তুমি একটুও ভেবাে না ।
—তাই যেন হয় মা , তােরা যেন জীবনের সব বাধাবিপত্তি জয় করে নিজেদের সাধনায় সফল হয়ে উঠতে পারিস ।
বাবার এই আশীর্বাদ আশ্চর্যভাবে সফল হয়েছিল , মেরী আর তার দিদির জীবনে ।
প্রথমে মেরীই এগিয়ে এলেন । ঠিক করলেন নিজে লােকের বাড়ি গর্ভনেসের চাকরি নিয়ে দিদিকে পাঠাতে থাকবেন টাকা । কথা রইল দিদি ডাক্তারি পাশ করে যখন প্র্যাকটিস শুরু করবে তখন তার টাকায় । মেরী ভর্তি হবে কলেজে আর শুরু করবে বিজ্ঞান সাধনা ।
একজন ধনী ল - ইয়ারের বাড়ি গর্ভনেসের চাকরি নিলেন মেরী । মাইনে বছরে ৪০০ রু আর থাকা খাওয়া । পড়াশােনার সুযােগ তাে কণামাত্র নেই সেইসঙ্গে সারাদিন বাড়িতে অতিথি আপ্যায়নের ভিড় । সারাদিন চলে বিলাসিতার স্রোত । মেরীকে অংশ নিতেই হয় সবকিছুতে— যা তিনি একেবারেই পছন্দ করেন না ।
বিরক্ত হয়ে চাকরি ছেড়ে দিলেন । নতুন চাকরি পেলেন গ্রামে । মাইনে ৫০০ রুবল । এখানে আছে লাইব্রেরি । নিজের কাজের ফাঁকে ফাকেই লাইব্রেরিতে চলে যান । একমনে পড়তে থাকেন সমাজতত্ত্ব আর পদার্থবিদ্যার বই । কঠিন কোন অঙ্ক না পারলে বাবাকে চিঠি লিখে খুঁজে নিতেন সমাধান সূত্র । গ্রামে এসে মেরী দেখলেন ছােটো ছােটো ছেলেমেয়েরা লেখাপড়ার সুযােগ পায়না তাই নিজের গর্ভনেসের চাকরি আর পড়াশােনারে মধ্যেও প্রতিদিন ২ ঘন্টা করে সময় বের করে নিয়ে ঐসব চাষার ছেলেদের পড়াতেন মেরী । খাতা , কলম কিনে দিতেন নিজের মাইনের টাকা থেকে । বাকি টাকা পাঠাতেন বাবাকে আর দিদিকে । নিজের বিলাসিতার জন্য কোনাে খরচ ছিল না তার । তরুণী বয়স থেকে বৃদ্ধা বয়স পর্যন্ত একেবারে সহজ সরল অনাড়ম্বর । জীবন্যাত্রা ছিল তার ।
অবশেষে ২৪ বছর বয়সে সুযােগ এলাে মেরীর জীবনে । এবার দিদির অর্থানুকূল্যে সােরবাের্ন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে জোর উদ্যমে বিজ্ঞানের পাঠ নেওয়া শুরু করে দিল মেরী । পাশ করল ফিজিক্সে প্রথম ও গণিতে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে । বছরে ৬০০ রুল স্কলারশিপও পেয়ে গেল পােল্যান্ড সরকারের কাছ থেকে । এবার নিশ্চিন্তে গবেষণা করতে হবে । কিন্তু কোথায় ভালাে ল্যাবরেটরি যেখানে ইচ্ছামতাে গবেষণার সুযােগ আছে ? খুঁজতে খুঁজতে পরিচিত এক ব্যক্তি জানালেন পীয়ের কুরী নামের এক অধ্যাপকের ল্যাব প্রায় খালি পড়ে আছে । মেরী গিয়ে দেখা করলেন । পীয়ের সানন্দে তাকে নিজের ল্যাবরেটরিতে স্বাধীনভাবে গবেষণার অনুমতি দিলেন ।
গবেষণা শেষে এরপর গ্রামের বাড়িতে ফিরে আসতে চাইলেন মেরী । কিন্তু পীয়ের তাকে বাধা দিলেন । বললেন— মেরীর মতাে উচ্চ প্রতিভাময়ীর উচিত বিশ্ববিজ্ঞানের জন্য কিছু করা । অগত্যা ৫০০ ফ্রী মাইনের গরিব অধ্যাপক পীয়ের কুরীর সঙ্গে জীবনের গাঁটছড়া বাধলেন মেরী । মাদাম মেরী ক্রোদোভস্কি থেকে হলেন মেরী কুরি ।
শুরু হল মেরীর সংসার জীবন । স্বামী স্ত্রী আর বৃদ্ধ শ্বশুরকে নিয়ে সংসার । ঝি চাকরের বালাই নেই । ভােরে উঠে বাজার করা থেকে রান্না , বাসন ধােয়া , ঘরদোর পরিষ্কার করা , জামা কাপড় কাচা- সবই একা হাতে সারতেন মেরী । ঘরের সব কাজ সেরে চলে যেতেন ল্যাবরেটরিতে । আটঘণ্টা টানা চলত গবেষণা । আর ল্যাবরেটরিরই বা কি শ্রী ! একটা স্কুলের একতলায় ছােট্ট স্যাতসেঁতে একটা ঘর । সেখানে ঢােকে আলাে , না ঢােকে বাতাস । সাজসরঞ্জামের অবস্থা আরও শােচনীয় । তবু এরই মধ্যে বসে বসে দিনের পর দিন রাতের পর রাত অবিচ্ছিন্ন গবেষণা চালিয়ে গেলেন মেরী কুরী এবং তার স্বামী পীয়ের কুরী । এই গবেষণাই একদিন তাদের এনে দিল বিশ্বজয়ের মুকুট । ততােদিনে দুজন অতিথি এসেছে সংসারে । আইরিন ও ইভ দুটি ফুটফুটে ফুলের মতাে মেয়ে । বড় মেয়ে আইরিনি কুরী ভবিষ্যতের আর এক নােবেল বিজয়িনী ।
রেডিয়াম আবিষ্কারের জন্য মেরী কুরী ও তার স্বামী নােবেল পুরস্কার । পেয়েছিলেন যৌথভাবে ১৯০৩ সালে । কিন্তু বড়াে সহজে তাদের কাছে । ধরা দেয়নি এই অমূল্য সম্পদ । যেভাবে মেরী ও পীয়ের রেডিয়ামের হদিস পেয়েছিলেন সে এক আশ্চর্য কাহিনি । হার না মানার এক অলৌকিক রূপকথা ।
রঞ্জন রশ্মি বা এক্স - রে নিয়ে তখন গবেষণা করছিলেন তারা দুজন । কিছুদিন গবেষণা করার পর তারা দেখলেন ইউরেনিয়াম বেশি থাকলে রশ্মির তীব্রতা বেশি হয় । শুরু হল ইউরেনিয়াম যৌগ নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা । হঠাৎ দেখা গেল কিছু কিছু ক্ষেত্রে ray বের হচ্ছে অনেক বেশি পরিমাণে । ১০ বার পরীক্ষা হল । একই ফল । বৈজ্ঞানিকরা অবাক হয়ে ভাবতে লাগলেন কোত্থেকে এলাে এতাে রশ্মি ? নিশ্চয়ই খনি থেকে ইউরেনিয়াম তােলার সময় বিশেষ কিছু জিনিস তার সঙ্গে মিশে গেছে । শুরু হল অনুসন্ধান ।
অপরিষ্কার ইউরেনিয়ামের ঢেলা ( dh ) বা পিচব্লেন্ডকে পরীক্ষাগারে আলাদা আলাদা করে ভাগ করে ফেলা হল । পরিচিত অন্যান্য এলিমেন্ট ছাড়াও নতুন ২ টি বস্তু আছে বােঝা গেল । তার মধ্যে একটিকে চিহ্নিত করে ফেললেন মেরী । নাম দিলেন তাঁর প্রিয় স্বদেশের নামে পােলােনিয়াম ।
কিন্তু অপরটি ? কোথায় সে ? আরাে পরীক্ষা চাই । চাই প্রচুর প্রচুর পরিমাণে পিচব্লেন্ড । কিন্তু অত দামী পদার্থ কোথায় পাবেন তারা ? তবে কি হার মানতে হবে ? হাল ছেড়ে দিতে হবে শেষটায় ?
না কখনাে না । কিভাবে সস্তায় প্রচুর পিচব্লেন্ড পাওয়া যাবে তারই খোঁজ করতে লাগলেন তাঁরা ।
শেষে উপায় হল । পীয়ের খবর পেলেন বােহেমিয়ার এক খনি থেকে পীচব্লেন্ড তুলে তার থেকে ইউরেনিয়াম লবণ বের করে নেওয়া হয় । কাজ হয়ে যাবার পর ফেলে দেওয়া হয় মহামূল্যবান পীচব্লেন্ড ।
পীয়েরের অনুরােধে সেই অকেজো ইউরেনিয়ম থেকে এক টন পিচব্লেন্ড , কয়লা বওয়া একটা ট্রাকে ভরে কুরী দম্পতির বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেন খনির মালিক , সম্পূর্ণ বিনামূল্যে ।
পাওয়া তাে গেল , কিন্তু রাখা হবে কোথায় ? বড়াে কড়াইতে রেখে উচ্চতাপে জ্বাল দিতে হবে ওই পদার্থ । তার জন্য চাই বিশেষ ধরনের আলাদা ল্যাবরেটরি । কিভাবে মিলবে তা ?
এবারও সমাধান হল আশ্চর্য উপায়ে । পীয়ের যেখানে কাজ করেন সেই স্কুল অব ফিজিক্স এন্ড কেমিস্ট্রি - র শরীরবিদ্যা বিভাগের ছাত্ররা একটা ঘরে মড়া কাটত । বর্তমানে সেই ঘরটি পরিত্যক্ত । তারই নােংরা কাঁচা মাটির মেঝেতে তূপীকৃত করে রাখা হল পীচব্লেন্ডের পাহাড় আর ঘরের বারান্দায় , তােলা উনুন বসিয়ে শুরু হয়ে গেল গবেষণার কাজ । দিন নেই রাত নেই , প্রকাণ্ড মাথা সমান উঁচু একটা ভারী রঙ দিয়ে উত্তপ্ত পীচব্লেন্ড নেড়ে যেতেন মেরী । দরদর করে সারা শরীর বেয়ে গড়িয়ে পড়ত ঘাম । ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ত শরীর । এমনি করে কেটে গেল চার চারটে বছর । হঠাৎ বৃষ্টি এলেই দৌড়ে ঢুকে পড়তে হত ঘরে । হুড়মুড় করে জিনিসপত্র ঘরে তুলতে হত । ভিজে গেলেই সর্বনাশ । দৌড়ঝাঁপ করতে করতে প্রণান্ত হয়ে যেত দুই বিজ্ঞানীর ।
সেদিন রাত ৯ টা নাগাদ ঘরে ফিরে সংসারের টুকিটাকি কাজ সারছিলেন মেরী । হঠাৎ মেয়ে আইরিনের একটি ফ্রক সেলাই করতে করতে কি জানি কি মনে হল তার । স্বামীকে ডেকে বললেন- চলাে । আর একবার ল্যাবে ঘুরে আসি ।
পীয়েরকেও কেন জানি ল্যাবটা যেন টানছিল । তিনিও বললেন , বেশ চলাে ।
বৃদ্ধ শ্বশুরকে “ বাবা , আমরা একটু বেরােচ্ছি— ' বলেই প্রায় ছুটতে ছুটতে সেই ফুটো চালের স্যাতসেঁতে ছােটো ঘরে এসে হাজির হলেন তারা । দরজা খুলেই অবাক হয়ে গেলেন । সারা ঘর আলােয় আলাে হয়ে গেছে— বিশ্লিষ্ট পীচব্লেন্ডের মাঝখানে পড়ে আছে এক টুকরাে অমুল্য রত্ন , সাত রাজার ধন মানিক । মেরী ও পিয়ের তার নাম দিলেন রেডিয়াম । সহস্র দুঃখের সাধনায় সিদ্ধিলাভ হল ।
১৯০৩ সালে এলাে নােবেল পুরস্কার ।
পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে আসা অভিনন্দন আর প্রশংসার বন্যা ভাসিয়ে দিল এতােদিনের সব দুঃখকষ্ট ।
এখানেই কিন্তু মেরী কুরীর যাত্রা থামল না । ক্রমাগত তেজোস্ক্রিয় পদার্থ নিয়ে কাজ করার ফলে তার শরীরে এক ধরনের অসুখ দেখা দিল । সেই রেডিয়াম আবিষ্কারের বছর থেকেই রােগযন্ত্রণার কবলে পড়লেন তিনি । সারা শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা । ডাক্তার বলত বাত । পরে অবশ্য জানা গিয়েছিল বাত নয় , মেরীকে আক্রমণ করেছে এক কালব্যাধি । তবু হার মানেন নি নােবেল বিজয়িনী । অসহ্য রােগযন্ত্রণা নিয়েই ঝাপিয়ে পড়েছেন কাজে আবার নতুন উদ্যমে ।
এবারের কাজ মানব সেবার । নােবেল ছাড়াও মেরী একা পেয়েছিলেন ওসিরিজ প্রাইজ যার অর্থমূল্য ৫০ হাজার ফ্লা । এতাে টাকা নিয়ে কি করবেন ? দারিদ্র তাে তার চিরঅভ্যস্ত । তাই পুরস্কারলব্ধ সমস্ত অর্থ দিয়ে মেরী চাইলেন দেশে দেশে ক্যানসার চিকিৎসার ও গবেষণার কেন্দ্র গড়ে তুলতে । তার জন্য চাই আরাে টাকা , আরাে রেডিয়াম যার এক গ্রামের দাম তখনকার দিনে ছিল ৩১২,৫০০ ডলার । তার জন্য শুরু হল আবেদন ও প্রচারের কাজ । তার ওপর সংসারে এসেছে দ্বিতীয়া কন্যা ইভ । মেরীর নিঃশ্বাস ফেলার সময় নেই ।
সহসা ঘটল বিনামেঘে বজ্রপাত । অন্যমনস্ক ভাবে পথে চলবার সময় ঘােড়ার গাড়ি চাপা পড়ে মারা গেলেন স্বামী পীয়ের । চিরদিনের সাথী , দীর্ঘ যুদ্ধের সহযােদ্ধা , প্রিয়তম এই মানুষটির এইরকম শােচনীয় মৃত্যুতে শােকে নির্বাক হয়ে গেলেন মেরী ।
কিন্তু হাল ছাড়লেন না । স্বামীর অসমাপ্ত গবেষণার কাজ হাতে তুলে । নিলেন । নিলেন তার কলেজের সর্বময় কর্তৃত্বের দায়িত্ব । নিজের হাতে । গড়ে তােলা স্বপ্নের ল্যাবরেটরি ও গবেষণার কাজ । সেইসঙ্গে অব্যাহত রইল শিশুকন্যাদের মানুষ করে তােলা , শােকার্ত , রুগ্ন বৃদ্ধ শ্বশুরের শুশ্রষা , আর বই লেখার কাজ । রেডিয়াম বিষয়ে তাঁর গবেষণার কাজ ও নিজের জীবনের নানা অভিজ্ঞতা নিয়ে একের পর এক বই লিখে চললেন মেরী । ১৯১১ সালে রসায়নে আবার নােবেল পুরস্কার পেলেন মেরী ।
১৯১৪ সালে শুরু হল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ । চারিদিকে মৃত্যু আর হাহাকার । ল্যাবরেটরির শান্ত নিরাপত্তায় বসে অস্থির হয়ে উঠলেন মমতাময়ী মেরী । যুদ্ধে আহত অসংখ্য আর্ত মানুষের অসহায় কান্নায় পথে এসে দাঁড়ালেন তিনি । ফ্লোরেন্স নাইটিংগেলের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে নিজেই সংগ্রহ করে ফেললেন অনেকগুলি এক্স - রে মেশিন । প্যারিস হাসপাতালে সেগুলি দান করলেন যাতে প্রচুর আহত রােগীর রােগ নির্ণয় করা যায় যতাে শীঘ্র সম্ভব । নিজেই নির্দেশ দিয়ে তৈরি করালেন । বিশেষ এক ধরনের ভ্রাম্যমান গাড়ি , নাম রেডিওলজিক্যাল গাড়ি । এই গাড়িগুলিতে থাকত একটি ডায়নামাে ও একটি এক্স - রে মেশিন । ডায়নামাে চলত গাড়ির মােটরের সাহায্যে আর একই সঙ্গে তৈরি হয়ে যেত প্রচুর বিদ্যুত । গাড়িটি হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরে ঘুরে রােগীর চিকিৎসায় সাহায্য করত । সাধারণ দরিদ্র মুখ মানুষরা যখন ভয় পেয়ে কাছে আসতে চাইত না তখন মেরী তাদের আদর করে ডাকতেন । স্নিগ্ধ মধুর ব্যবহারে ভাঙিয়ে দিতেন তাদের ভয় । মেরীর চেষ্টায় ফ্রান্সের মতাে পােল্যান্ডে ও রেডিয়াম ইনস্টিটিউট ও ক্যান্সার রিসার্চ কেন্দ্র তৈরি হল ।
নিজের জীবনের সমস্ত উপার্জিত অর্থ মেরী কুরী অকাতরে ঢেলে দিলেন মানবসেবায় । তার সততায় , ত্যাগ আর অক্লান্ত সেবার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে এগিয়ে এসে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল পৃথিবীর নানা দেশ , নানা সংগঠন । দু - দুবার নােবেল - বিজয়িনী প্রমাণ করলেন তিনি যতাে বড়াে বিজ্ঞানী তার চেয়েও অনেক বড়াে মানুষ ।
দীর্ঘ রােগযন্ত্রণাও তাকে একদিনের জন্য কাজ থেকে বিশ্রাম নেওয়াতে পারেনি । পারেনি ক্লান্তি কিংবা হতাশার গ্রাসে পড়ে হারিয়ে যেতে দিতে । দীর্ঘদিন রেডিয়াম নিয়ে কাজ করার ফলে মেরীর শরীরে যে দুরারােগ্য ব্যাধির সংক্রমণ ঘটেছিল তাতেই মৃত্যু হল তার । কিন্তু মৃত্যুর ১ মিনিট আগে পর্যন্তও তিনি বলেন নি ভয় বা দুঃখের কোনাে কথা বলেন নি আত্মীয় বা বন্ধুদের প্রতি কোনাে নির্দেশ বা বিদায়বাণী । শেষমুহূর্ত পর্যন্ত মেরী কুরী সবাইকে তাঁর কাজের কথাই বলে গেছেন । বলেছেন একটু ভালাে হয়ে উঠেই আবার শুরু করবেন কাজ কতাে কাজ যে পড়ে আছে !
দারিদ্র্য , শােক , দুঃখ তাকে হার মানাতে পারেনি , মৃত্যুও তাকে হার মানাতে পারল না ।
Patience and perseverence overcome mountains . —মহাত্মা গান্ধী ।
0 Comments: