Meri Curi ( মেরী কুরী ) | Meri Curi Biography In Bengali | Two nobel winner Meri Curi success life story bangla | Bangla Inspriational Success Story

Bangla success story :- This success story written by jayanti chakrabarti.This story revolves around Meri Curi like meri curie biography.We are collected this type success story that revive your lost mind.You get more success story on bengali in our website. And I think  all success story will take place in your mind.So please share this story to your friends and I sure they will also benefit from this success story.Thank you so much.                            

                                       মেরী কুরী 


Meri Curi success life story


প্রচণ্ড দারিদ্র্য , অসহনীয় শােক আর অবর্ণনীয় রােগযন্ত্রণাকে পরােয়া করে যে বীরাঙ্গনা নারী পৃথিবীকে চমকে দিয়ে দু দুবার নােবেল পুরস্কার অর্জন করেছিলেন তিনিই মাদাম মারিয়া কুরী । এমন লড়াকু চরিত্রের নারী পৃথিবীর ইতিহাসে আর দুটি আছে কিনা আমি জানি না । জানি না— একাধারে জ্ঞান তপস্যা আর মানবসেবার কাজ এভাবে বিশ্বের আর কেউ কখনাে চালিয়ে গেছেন কিনা ।

       ১৮৬৭ খ্রি . নভেম্বর পােল্যান্ডের এক শহরে শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত পরিবারে মাদাম মেরী স্কোলাডােভস্কির জন্ম । বাবা ভ্রাডিস্লাব ক্লেদোভস্কি বিজ্ঞানের শিক্ষক । পরবর্তীকালে বেশ কিছুদিন কলেজে ও বিজ্ঞানের অধ্যাপনা করেন । মা হেডমিসট্রেস । পাঁচ ভাইবােনের জমজমাট পরিবার । প্রতিটি ভাইবােন বুদ্ধিমান । বিশেষ করে সেজো বােন মেরি প্রতিটি বিষয়ে স্কুলে প্রথম । বাবা মা আর দিদিদের বড়াে আদরের মান্না বা মানুসুয়াকে নিয়ে সবাই স্বপ্ন দেখে একদিন অনেক , অনেক বড়াে হবে সে । 

মান্নার যখন বছর বয়স তখন মারা গেল তার আদরের বড়াে বােন । জোসিয়া । এতাে ছােটো বয়সে জীবনে প্রথম মৃত্যুকে দেখল সে । মা ছিলেন থাইসিস রুগী । মেয়েদের কোলে পিঠে নিয়ে আদর করা , তাদের দেখাশােনা করা— এসব থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতেন । মায়ের অভাবপূরণ করত যে বড়াে দিদি ভগবান তাকেই কেড়ে নিলেন । দিদির শােক ভুলতে না ভুলতে মারা গেলেন মা । মেরীর বয়স তখন মাত্র ১০ । রুগ্ন মা - কে পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ভালােবাসত সে । মায়ের শােক ভুলতে বাবার স্টাডিতে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিত সে । নানা রকমের বই পড়ত মেরী , সেইসঙ্গে মেজদি ব্রোন্নাকেও সাহায্য করত সংসারের নানা কাজে । আবার স্কুলের বেলায় বইপত্র গুছিয়ে স্কুলে চলে যেত মান্না । এভাবেই যােলাে বছর বয়সে স্কুলের শেষ পরীক্ষায় বসল আর সােনার মেডেল নিয়ে পাশও করে গেল মেরী , অনায়াসে ।

         কিন্তু এর আগেই সংসারের ওপর নেমে এসেছে আরাে বড়াে অভিশাপ । পােল্যান্ড তখন রাশিয়ার দখলে । কিন্তু স্বদেশভক্ত ক্রোডােভস্কি পরিবার কোনােদিনই রুশ শাসনকে মেনে নিতে পারেনি । আত্মমর্যাদা সম্পন্ন ভদ্রলােক মেরীর বাবা তাই স্কুলের চাকরিটি হঠাৎ খােয়ালেন । স্কুল কলেজ সর্বত্রই তখন রাশিয়ার কড়া খবরদারি । এতােগুলি শিশুর খাওয়া পরা ও শিক্ষা কিভাবে চলবে এ প্রশ্নের কোনাে উত্তর খুঁজে পেলেন না তিনি । বাধ্য হয়ে সােনার মেডেল পাওয়া সােনার মেয়েকেও স্কুল ছাড়তে হল । চলে গেলেন অজ পাড়াগাঁয়ে জনৈক আত্মীয়ের বাড়ি । কিন্তু হতাশায় মুষড়ে পড়লেন । বরং পল্লীবাসের দিনগুলিকে কাজে লাগিয়ে অনায়াসে শিখে নিলেন কেমন করে ঘােড়ায় চড়তে হয় , নৌকা চালাতে হয় । ভাগ্যকে দোষ না । দিয়ে শান্তভাবেই মেনে নিলেন পরিস্থিতির কঠোরতা । কিন্তু বেশিদিন গ্রামে থাকতে পারলেন না মেরী । বাবা আর ভাইবােনদের থেকে দূরে থাকা অনাহারের চেয়েও কঠিন তাঁর কাছে । তাই বাড়ি ফিরে এসে বাড়ি বাড়ি টিউশান শুরু করে দিলেন ।

          সতেরাে বছরের সুন্দরী ফুটফুটে মেয়েটি সারাদিন এবাড়ি থেকে ওবাড়ি ছাত্রী পড়িয়ে পড়িয়ে ঘুরছেন । তার মাইনে যেমন সামান্য তেমনি অনিয়মিত । কিছু বলতে গেলেই পত্রপাঠ বিদায় । ধনী গিন্নীরা কততদিন বসিয়ে রেখেছে তাকে অকারণে , কতােদিন অপমান করেছে , করেছে তাচ্ছিল্য । তবু ১৭ বছরের মেয়েটির ধৈর্যচ্যুতি ঘটেনি । এতােকিছুর ফাকে ফাকেও ঠিক চালিয়ে গেছে নিজের পড়াশােনা । সেইসময় পােল্যান্ডে floating university বলে একরকম ভ্রাম্যমান পাঠাগার ছিল । দারিদ্র্য বা অন্য কোনাে কারণে যারা কলেজে পড়তে পারত না তাদের পড়াশােনা চালিয়ে যেতে সবরকম সাহায্য করত এই floating university । মেরীও এই floating university তে পড়তে লাগলেন আর স্বপ্ন দেখতে লাগলেন সােরবেন ইউনিভার্সিটি থেকে বিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষা লাভ করবেন তারপর স্বদেশে ফিরে এসে সেবা করবেন দেশজননীর । 

          স্বপ্ন দেখতেন তার মেজদি ব্রোন্নাও । প্যারিসে গিয়ে ডাক্তারি পড়বেন । কিন্তু কোথায় টাকা , কোথায় কি ? অসহায় বাবা আদরের মেয়েদের এই অপূর্ণ স্বপ্নের যন্ত্রণা চোখের ওপর চেয়ে চেয়ে দেখতেন আর অঝােরে কাঁদতেন , বাবা হিসেবে নিজের ব্যর্থতায় ।

   - “ বুড়াে বাপকে তােরা ক্ষমা করিস মা ।

              দুই মেয়ে আদর করে বাবার চোখ মুছিয়ে দিয়ে বলতেন- দেখাে বাবা , আমরা একদিন ঠিক আমাদের স্বপ্ন সার্থক করব । তুমি একটুও ভেবাে না । 

   —তাই যেন হয় মা , তােরা যেন জীবনের সব বাধাবিপত্তি জয় করে নিজেদের সাধনায় সফল হয়ে উঠতে পারিস । 

       বাবার এই আশীর্বাদ আশ্চর্যভাবে সফল হয়েছিল , মেরী আর তার দিদির জীবনে । 

       প্রথমে মেরীই এগিয়ে এলেন । ঠিক করলেন নিজে লােকের বাড়ি গর্ভনেসের চাকরি নিয়ে দিদিকে পাঠাতে থাকবেন টাকা । কথা রইল দিদি ডাক্তারি পাশ করে যখন প্র্যাকটিস শুরু করবে তখন তার টাকায় । মেরী ভর্তি হবে কলেজে আর শুরু করবে বিজ্ঞান সাধনা ।

    একজন ধনী ল - ইয়ারের বাড়ি গর্ভনেসের চাকরি নিলেন মেরী । মাইনে বছরে ৪০০ রু আর থাকা খাওয়া । পড়াশােনার সুযােগ তাে কণামাত্র নেই সেইসঙ্গে সারাদিন বাড়িতে অতিথি আপ্যায়নের ভিড় । সারাদিন চলে বিলাসিতার স্রোত । মেরীকে অংশ নিতেই হয় সবকিছুতে— যা তিনি একেবারেই পছন্দ করেন না । 

       বিরক্ত হয়ে চাকরি ছেড়ে দিলেন । নতুন চাকরি পেলেন গ্রামে । মাইনে ৫০০ রুবল  । এখানে আছে লাইব্রেরি । নিজের কাজের ফাঁকে ফাকেই লাইব্রেরিতে চলে যান । একমনে পড়তে থাকেন সমাজতত্ত্ব আর পদার্থবিদ্যার বই । কঠিন কোন অঙ্ক না পারলে বাবাকে চিঠি লিখে খুঁজে নিতেন সমাধান সূত্র । গ্রামে এসে মেরী দেখলেন ছােটো ছােটো ছেলেমেয়েরা লেখাপড়ার সুযােগ পায়না তাই নিজের গর্ভনেসের চাকরি আর পড়াশােনারে মধ্যেও প্রতিদিন ২ ঘন্টা করে সময় বের করে নিয়ে ঐসব চাষার ছেলেদের পড়াতেন মেরী । খাতা , কলম কিনে দিতেন নিজের মাইনের টাকা থেকে । বাকি টাকা পাঠাতেন বাবাকে আর দিদিকে । নিজের বিলাসিতার জন্য কোনাে খরচ ছিল না তার । তরুণী বয়স থেকে বৃদ্ধা বয়স পর্যন্ত একেবারে সহজ সরল অনাড়ম্বর । জীবন্যাত্রা ছিল তার । 

       অবশেষে ২৪ বছর বয়সে সুযােগ এলাে মেরীর জীবনে । এবার দিদির অর্থানুকূল্যে সােরবাের্ন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে জোর উদ্যমে বিজ্ঞানের পাঠ নেওয়া শুরু করে দিল মেরী । পাশ করল ফিজিক্সে প্রথম ও গণিতে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে । বছরে ৬০০ রুল স্কলারশিপও পেয়ে গেল পােল্যান্ড সরকারের কাছ থেকে । এবার নিশ্চিন্তে গবেষণা করতে হবে । কিন্তু কোথায় ভালাে ল্যাবরেটরি যেখানে ইচ্ছামতাে গবেষণার সুযােগ আছে ? খুঁজতে খুঁজতে পরিচিত এক ব্যক্তি জানালেন পীয়ের কুরী নামের এক অধ্যাপকের ল্যাব প্রায় খালি পড়ে আছে । মেরী গিয়ে দেখা করলেন । পীয়ের সানন্দে তাকে নিজের ল্যাবরেটরিতে স্বাধীনভাবে গবেষণার অনুমতি দিলেন । 

      গবেষণা শেষে এরপর গ্রামের বাড়িতে ফিরে আসতে চাইলেন মেরী । কিন্তু পীয়ের তাকে বাধা দিলেন । বললেন— মেরীর মতাে উচ্চ প্রতিভাময়ীর উচিত বিশ্ববিজ্ঞানের জন্য কিছু করা । অগত্যা ৫০০ ফ্রী মাইনের গরিব অধ্যাপক পীয়ের কুরীর সঙ্গে জীবনের গাঁটছড়া বাধলেন মেরী । মাদাম মেরী ক্রোদোভস্কি থেকে হলেন মেরী কুরি । 

         শুরু হল মেরীর সংসার জীবন । স্বামী স্ত্রী আর বৃদ্ধ শ্বশুরকে নিয়ে সংসার । ঝি চাকরের বালাই নেই । ভােরে উঠে বাজার করা থেকে রান্না , বাসন ধােয়া , ঘরদোর পরিষ্কার করা , জামা কাপড় কাচা- সবই একা হাতে সারতেন মেরী । ঘরের সব কাজ সেরে চলে যেতেন ল্যাবরেটরিতে । আটঘণ্টা টানা চলত গবেষণা । আর ল্যাবরেটরিরই বা কি শ্রী ! একটা স্কুলের একতলায় ছােট্ট স্যাতসেঁতে একটা ঘর । সেখানে ঢােকে আলাে , না ঢােকে বাতাস । সাজসরঞ্জামের অবস্থা আরও শােচনীয় । তবু এরই মধ্যে বসে বসে দিনের পর দিন রাতের পর রাত অবিচ্ছিন্ন গবেষণা চালিয়ে গেলেন মেরী কুরী এবং তার স্বামী পীয়ের কুরী । এই গবেষণাই একদিন তাদের এনে দিল বিশ্বজয়ের মুকুট । ততােদিনে দুজন অতিথি এসেছে সংসারে । আইরিন ও ইভ দুটি ফুটফুটে ফুলের মতাে মেয়ে । বড় মেয়ে আইরিনি কুরী ভবিষ্যতের আর এক নােবেল বিজয়িনী । 

       রেডিয়াম আবিষ্কারের জন্য মেরী কুরী ও তার স্বামী নােবেল পুরস্কার । পেয়েছিলেন যৌথভাবে ১৯০৩ সালে । কিন্তু বড়াে সহজে তাদের কাছে । ধরা দেয়নি এই অমূল্য সম্পদ । যেভাবে মেরী ও পীয়ের রেডিয়ামের হদিস পেয়েছিলেন সে এক আশ্চর্য কাহিনি । হার না মানার এক অলৌকিক রূপকথা । 

    রঞ্জন রশ্মি বা এক্স - রে নিয়ে তখন গবেষণা করছিলেন তারা দুজন । কিছুদিন গবেষণা করার পর তারা দেখলেন ইউরেনিয়াম বেশি থাকলে রশ্মির তীব্রতা বেশি হয় । শুরু হল ইউরেনিয়াম যৌগ নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা । হঠাৎ দেখা গেল কিছু কিছু ক্ষেত্রে ray বের হচ্ছে অনেক বেশি পরিমাণে । ১০ বার পরীক্ষা হল । একই ফল । বৈজ্ঞানিকরা অবাক হয়ে ভাবতে লাগলেন কোত্থেকে এলাে এতাে রশ্মি ? নিশ্চয়ই খনি থেকে ইউরেনিয়াম তােলার সময় বিশেষ কিছু জিনিস তার সঙ্গে মিশে গেছে । শুরু হল অনুসন্ধান । 

        অপরিষ্কার ইউরেনিয়ামের ঢেলা ( dh ) বা পিচব্লেন্ডকে পরীক্ষাগারে আলাদা আলাদা করে ভাগ করে ফেলা হল । পরিচিত অন্যান্য এলিমেন্ট ছাড়াও নতুন ২ টি বস্তু আছে বােঝা গেল । তার মধ্যে একটিকে চিহ্নিত করে ফেললেন মেরী । নাম দিলেন তাঁর প্রিয় স্বদেশের নামে পােলােনিয়াম ।

        কিন্তু অপরটি ? কোথায় সে ? আরাে পরীক্ষা চাই । চাই প্রচুর প্রচুর পরিমাণে পিচব্লেন্ড । কিন্তু অত দামী পদার্থ কোথায় পাবেন তারা ? তবে কি হার মানতে হবে ? হাল ছেড়ে দিতে হবে শেষটায় ? 

        না কখনাে না । কিভাবে সস্তায় প্রচুর পিচব্লেন্ড পাওয়া যাবে তারই খোঁজ করতে লাগলেন তাঁরা । 

        শেষে উপায় হল । পীয়ের খবর পেলেন বােহেমিয়ার এক খনি থেকে পীচব্লেন্ড তুলে তার থেকে ইউরেনিয়াম লবণ বের করে নেওয়া হয় । কাজ হয়ে যাবার পর ফেলে দেওয়া হয় মহামূল্যবান পীচব্লেন্ড । 

         পীয়েরের অনুরােধে সেই অকেজো ইউরেনিয়ম থেকে এক টন পিচব্লেন্ড , কয়লা বওয়া একটা ট্রাকে ভরে কুরী দম্পতির বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেন খনির মালিক , সম্পূর্ণ বিনামূল্যে । 

       পাওয়া তাে গেল , কিন্তু রাখা হবে কোথায় ? বড়াে কড়াইতে রেখে উচ্চতাপে জ্বাল দিতে হবে ওই পদার্থ । তার জন্য চাই বিশেষ ধরনের আলাদা ল্যাবরেটরি । কিভাবে মিলবে তা ? 

        এবারও সমাধান হল আশ্চর্য উপায়ে । পীয়ের যেখানে কাজ করেন সেই স্কুল অব ফিজিক্স এন্ড কেমিস্ট্রি - র শরীরবিদ্যা বিভাগের ছাত্ররা একটা ঘরে মড়া কাটত । বর্তমানে সেই ঘরটি পরিত্যক্ত । তারই নােংরা কাঁচা মাটির মেঝেতে তূপীকৃত করে রাখা হল পীচব্লেন্ডের পাহাড় আর ঘরের বারান্দায় , তােলা উনুন বসিয়ে শুরু হয়ে গেল গবেষণার কাজ । দিন নেই রাত নেই , প্রকাণ্ড মাথা সমান উঁচু একটা ভারী রঙ দিয়ে উত্তপ্ত পীচব্লেন্ড নেড়ে যেতেন মেরী । দরদর করে সারা শরীর বেয়ে গড়িয়ে পড়ত ঘাম । ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ত শরীর । এমনি করে কেটে গেল চার চারটে বছর । হঠাৎ বৃষ্টি এলেই দৌড়ে ঢুকে পড়তে হত ঘরে । হুড়মুড় করে জিনিসপত্র ঘরে তুলতে হত । ভিজে গেলেই সর্বনাশ । দৌড়ঝাঁপ করতে করতে প্রণান্ত হয়ে যেত দুই বিজ্ঞানীর । 

        সেদিন রাত ৯ টা নাগাদ ঘরে ফিরে সংসারের টুকিটাকি কাজ সারছিলেন মেরী । হঠাৎ মেয়ে আইরিনের একটি ফ্রক সেলাই করতে করতে কি জানি কি মনে হল তার । স্বামীকে ডেকে বললেন- চলাে । আর একবার ল্যাবে ঘুরে আসি । 

       পীয়েরকেও কেন জানি ল্যাবটা যেন টানছিল । তিনিও বললেন , বেশ চলাে । 

       বৃদ্ধ শ্বশুরকে “ বাবা , আমরা একটু বেরােচ্ছি— ' বলেই প্রায় ছুটতে ছুটতে সেই ফুটো চালের স্যাতসেঁতে ছােটো ঘরে এসে হাজির হলেন তারা । দরজা খুলেই অবাক হয়ে গেলেন । সারা ঘর আলােয় আলাে হয়ে গেছে— বিশ্লিষ্ট পীচব্লেন্ডের মাঝখানে পড়ে আছে এক টুকরাে অমুল্য রত্ন , সাত রাজার ধন মানিক । মেরী ও পিয়ের তার নাম দিলেন রেডিয়াম । সহস্র দুঃখের সাধনায় সিদ্ধিলাভ হল ।

       ১৯০৩ সালে এলাে নােবেল পুরস্কার । 

       পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে আসা অভিনন্দন আর প্রশংসার বন্যা ভাসিয়ে দিল এতােদিনের সব দুঃখকষ্ট । 

        এখানেই কিন্তু মেরী কুরীর যাত্রা থামল না । ক্রমাগত তেজোস্ক্রিয় পদার্থ নিয়ে কাজ করার ফলে তার শরীরে এক ধরনের অসুখ দেখা দিল । সেই রেডিয়াম আবিষ্কারের বছর থেকেই রােগযন্ত্রণার কবলে পড়লেন তিনি । সারা শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা । ডাক্তার বলত বাত । পরে অবশ্য জানা গিয়েছিল বাত নয় , মেরীকে আক্রমণ করেছে এক কালব্যাধি । তবু হার মানেন নি নােবেল বিজয়িনী । অসহ্য রােগযন্ত্রণা নিয়েই ঝাপিয়ে পড়েছেন কাজে আবার নতুন উদ্যমে । 

         এবারের কাজ মানব সেবার । নােবেল ছাড়াও মেরী একা পেয়েছিলেন ওসিরিজ প্রাইজ যার অর্থমূল্য ৫০ হাজার ফ্লা । এতাে টাকা নিয়ে কি করবেন ? দারিদ্র তাে তার চিরঅভ্যস্ত । তাই পুরস্কারলব্ধ সমস্ত অর্থ দিয়ে মেরী চাইলেন দেশে দেশে ক্যানসার চিকিৎসার ও গবেষণার কেন্দ্র গড়ে তুলতে । তার জন্য চাই আরাে টাকা , আরাে রেডিয়াম যার এক গ্রামের দাম তখনকার দিনে ছিল ৩১২,৫০০ ডলার । তার জন্য শুরু হল আবেদন ও প্রচারের কাজ । তার ওপর সংসারে এসেছে দ্বিতীয়া কন্যা ইভ । মেরীর নিঃশ্বাস ফেলার সময় নেই । 

       সহসা ঘটল বিনামেঘে বজ্রপাত । অন্যমনস্ক ভাবে পথে চলবার সময় ঘােড়ার গাড়ি চাপা পড়ে মারা গেলেন স্বামী পীয়ের । চিরদিনের সাথী , দীর্ঘ যুদ্ধের সহযােদ্ধা , প্রিয়তম এই মানুষটির এইরকম শােচনীয় মৃত্যুতে শােকে নির্বাক হয়ে গেলেন মেরী । 

       কিন্তু হাল ছাড়লেন না । স্বামীর অসমাপ্ত গবেষণার কাজ হাতে তুলে । নিলেন । নিলেন তার কলেজের সর্বময় কর্তৃত্বের দায়িত্ব । নিজের হাতে । গড়ে তােলা স্বপ্নের ল্যাবরেটরি ও গবেষণার কাজ । সেইসঙ্গে অব্যাহত রইল শিশুকন্যাদের মানুষ করে তােলা , শােকার্ত , রুগ্ন বৃদ্ধ শ্বশুরের শুশ্রষা , আর বই লেখার কাজ । রেডিয়াম বিষয়ে তাঁর গবেষণার কাজ ও নিজের জীবনের নানা অভিজ্ঞতা নিয়ে একের পর এক বই লিখে চললেন মেরী । ১৯১১ সালে রসায়নে আবার নােবেল পুরস্কার পেলেন মেরী । 

          ১৯১৪ সালে শুরু হল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ । চারিদিকে মৃত্যু আর হাহাকার । ল্যাবরেটরির শান্ত নিরাপত্তায় বসে অস্থির হয়ে উঠলেন মমতাময়ী মেরী । যুদ্ধে আহত অসংখ্য আর্ত মানুষের অসহায় কান্নায় পথে এসে দাঁড়ালেন তিনি । ফ্লোরেন্স নাইটিংগেলের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে নিজেই সংগ্রহ করে ফেললেন অনেকগুলি এক্স - রে মেশিন । প্যারিস হাসপাতালে সেগুলি দান করলেন যাতে প্রচুর আহত রােগীর রােগ নির্ণয় করা যায় যতাে শীঘ্র সম্ভব । নিজেই নির্দেশ দিয়ে তৈরি করালেন । বিশেষ এক ধরনের ভ্রাম্যমান গাড়ি , নাম রেডিওলজিক্যাল গাড়ি । এই গাড়িগুলিতে থাকত একটি ডায়নামাে ও একটি এক্স - রে মেশিন । ডায়নামাে চলত গাড়ির মােটরের সাহায্যে আর একই সঙ্গে তৈরি হয়ে যেত প্রচুর বিদ্যুত । গাড়িটি হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরে ঘুরে রােগীর চিকিৎসায় সাহায্য করত । সাধারণ দরিদ্র মুখ মানুষরা যখন ভয় পেয়ে কাছে আসতে চাইত না তখন মেরী তাদের আদর করে ডাকতেন । স্নিগ্ধ মধুর ব্যবহারে ভাঙিয়ে দিতেন তাদের ভয় । মেরীর চেষ্টায় ফ্রান্সের মতাে পােল্যান্ডে ও রেডিয়াম ইনস্টিটিউট ও ক্যান্সার রিসার্চ কেন্দ্র তৈরি হল ।

        নিজের জীবনের সমস্ত উপার্জিত অর্থ মেরী কুরী অকাতরে ঢেলে দিলেন মানবসেবায় । তার সততায় , ত্যাগ আর অক্লান্ত সেবার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে এগিয়ে এসে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল পৃথিবীর নানা দেশ , নানা সংগঠন । দু - দুবার নােবেল - বিজয়িনী প্রমাণ করলেন তিনি যতাে বড়াে বিজ্ঞানী তার চেয়েও অনেক বড়াে মানুষ । 

       দীর্ঘ রােগযন্ত্রণাও তাকে একদিনের জন্য কাজ থেকে বিশ্রাম নেওয়াতে পারেনি । পারেনি ক্লান্তি কিংবা হতাশার গ্রাসে পড়ে হারিয়ে যেতে দিতে । দীর্ঘদিন রেডিয়াম নিয়ে কাজ করার ফলে মেরীর শরীরে যে দুরারােগ্য ব্যাধির সংক্রমণ ঘটেছিল তাতেই মৃত্যু হল তার । কিন্তু মৃত্যুর ১ মিনিট আগে পর্যন্তও তিনি বলেন নি ভয় বা দুঃখের কোনাে কথা বলেন নি আত্মীয় বা বন্ধুদের প্রতি কোনাে নির্দেশ বা বিদায়বাণী । শেষমুহূর্ত পর্যন্ত মেরী কুরী সবাইকে তাঁর কাজের কথাই বলে গেছেন । বলেছেন একটু ভালাে হয়ে উঠেই আবার শুরু করবেন কাজ কতাে কাজ যে পড়ে আছে ! 

      দারিদ্র্য , শােক , দুঃখ তাকে হার মানাতে পারেনি , মৃত্যুও তাকে হার মানাতে পারল না ।

       Patience and perseverence overcome mountains . —মহাত্মা গান্ধী ।


0 Comments: