বার্নার্ড প্যালিসি এর সফলতার কাহিনী | Motivational Story In Bengali

 বার্নার্ড প্যালিসি 

       ফ্রান্সের এক পাড়াগাঁয়ে জন্ম বার্নার্ড প্যালিসির। মানুষটি ছিলেন সৌখিন শিল্পী মনের মানুষ সাধারণত ফরাসিরা যেমন হয় ঠিক তেমনি । সারাদিন ছবি এঁকে , কাচে রঙ করে ভারি আনন্দে সময় কাটাতেন তিনি । মাঝে মঝে অবশ্য জরীপের কাজে এখানে ওখানে যেতে হত । সেটাই আসলে তার পেশা ছিল। আর ছবি আঁকা , কাচ রাঙানাে এসব ছিল নেশা । প্যালিসি তার পেশার চেয়ে নেশার পিছনেই বেশি সময় ব্যয় করতেন । 

       একদিন জরীপের কাজে এক জায়গায় গিয়ে প্যালিসির চোখে পড়ে গেল একটি মাটির পেয়ালা , যাকে আজকের ইংরেজি ভাষায় বলে কাপ । কাপটি দেখে প্যালিসি একেবারে আশ্চর্য হয়ে গেলেন । জিনিসটি সাধারণ মাটির তৈরি হলে কি হবে তার ওপর ছিল চমৎকার পালিশ করা এনামেলের কাজ । নিশ্চয়ই ফ্রান্সের বাইরের কোনাে দেশে তৈরি । একমাত্র ইটালির লােকেই জানে এইরকম আশ্চর্য বাসন তৈরির রহস্য। কিন্তু পাছে তাদের ব্যবসা মার খায় এই ভয়ে তারা সাবধানে সেই তত্ত্ব গােপন করে রেখেছিল । 

      প্যালিসি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে বসলেন ওই রকম বাসন তৈরি না করে তিনি ছাড়বেন না । যেমন প্রতিজ্ঞা তেমন কাজ। দিন নেই , রাত নেই প্যালিসির মনে একমাত্র চিন্তা , একমাত্র কাজ সৌখিন চকচকে মাটির বাসন বানাতেই হবে । 

      বাড়ির উঠোনে মস্ত এক উনুন বানিয়ে সারাদিন সেই উনুনে রাশি রাশি মাটি আর ভাঙা পাথরের গুড়াে গলিয়ে চলেছেন । নিজে লেখাপড়া কিছুই শেখেন নি । মাটির বাসনের ব্যবসায় কোনােদিন কোনাে অভিজ্ঞতাও নেই । সুযােগ বুঝি সহকারীরা বেশ দুপয়সা ঠকিয়ে নিতে লাগল উল্টোপাল্টা বুদ্ধি দিয়ে । প্যালিসির স্ত্রী এবং পরিবারের অন্যান্যরাও এই উদ্ভট পাগলামি দেখে বিরক্ত হয়ে উঠল । কিন্তু প্যালিসির কোনােদিকে কোনাে ভ্রুক্ষেপ নেই । সারাদিন উনুনের পাশে ধোঁয়ার কুণ্ডলীর মধ্যে বসে বসে তিনি নিজের মনে একের পর এক এক্সপেরিমেন্ট চালিয়ে যাচ্ছেন— ঠিক কি কি মিশিয়ে গলালে সেই গলিত পদার্থ চকচকে পালিশের কাজ করবে ঠিক যেমনটি তিনি চাইছেন । 

      টানা ২ বছর হাড়ভাঙা পরিশ্রম করার পর মােটামুটি একটা মশলা পাওয়া গেল । প্যালিসি শ - তিনেক মাটির কাপ তৈরি করে তার ওপর সেই মশলার প্রলেপ লাগিয়ে ৮ মাইল দূরের এক ব্যবসায়ীর চুল্লীতে পুড়তে দিলেন । বেশ কয়েকদিন ধরে কাপগুলাে পুড়ল । চুল্লীর আঁচ নিবলে পর দেখা গেল অতগুলাে কাপের মধ্যে মাত্র একটি কাপের গায়ে পালিশ ধরেছে । চমৎকার সাদা পালিশ । আনন্দে আটখাটা হয়ে গেলেন প্যালিসি । এবার তার মনে হল চুল্লীর দোষেই আগুন সব জায়গায় সমানভাবে পড়েনি । তাই একটি মাত্র কাপে পালিশ ধরেছে । 

       এই ভেবে প্যালিসি নিজের বাড়িতেই বাগানে একটি চুল্লী বানিয়ে ফেললেন । কুমােরদের হাঁড়ি কলসি পােড়াবার জন্যে যেমন পােন বা বিশাল চুল্লী থাকে সেইরকম একটা চুল্লী প্যালিসি নিজেই বানিয়ে নিলেন । ইটের পাজা থেকে ইট কিনে নিজেই মাথায় করে বয়ে আনলেন । তারপর ইটের পর ইট সাজিয়ে কুমােরদের নকলে চুল্লী তৈরি হল । এবার মাত্র একশাে মাটির কাপ তৈরি করে তার গায়ে মশলার প্রলেপ মাখিয়ে আবার পুড়তে দিলেন চুল্লীতে । অধীর আগ্রহ নিয়ে প্যালিসি বসে রইলেন চুল্লীর পাশে ।

        কিন্তু মশলা যে গলতেই চায় না । একদিন দুদিন করে ছয়দিন ছয়রাত পার হয়ে গেল । চুল্লীর আগুন নিভে গেল । কিন্তু কাপগুলি যেমন ছিল তেমনিই রয়ে গেল । 

      প্যালিসি কিন্তু হাল ছাড়লেন না । আবার নতুন করে কাঠ খুঁজে দিলেন চুল্লীতে । নাওয়া নেই , খাওয়া নেই , প্যালিসি সারাদিন কাঠ গুজে চলেছেন গনগনে আগুনের মধ্যে । 

      ক্রমে সব কাঠ ফুরিয়ে গেল । প্যালিসি তখন বাগানের কাঠের বেড়া ভেঙে আগুনের মধ্যে চালিয়ে দিলেন । তাও যখন ফুরােল তখন বাড়ির চেয়ার টেবিল যা সামনে পেলেন সব ভেঙে ভেঙে গুজে দিতে লাগলেন আগুনের মধ্যে । এদিকে বাড়িতে তখন রীতিমতাে কান্নাকাটি পড়ে গেছে ।

        ছেলেমেয়ের হাত ধরে প্যালিসির স্ত্রী বাড়ি ছেড়ে রাস্তায় বেরিয়ে এসে উদভ্রান্তের মতাে দৌড়তে লাগলেন আর লােকজনকে ডেকে ডেকে বলতে লাগলেন তার স্বামী পাগল হয়ে গেছেন । ঘরদোর সব ভেঙেচুরে পুড়িয়ে দিচ্ছেন । লােকে কৌতূহলী হয়ে প্যালিসির বাড়ি ছুটে এল ব্যাপারখানা কি দেখার জন্য ।

        কিন্তু প্যালিসির বাগানে গিয়ে ব্যাপার দেখে তাে সকলের চক্ষু চড়কগাছ । ততক্ষণে প্যালিসির চুল্লীর আঁচ নিভে গেছে । আর সেই গরম চুল্লীর ভেতর থেকে অতি সাবধানে একটি একটি করে কাপগুলি বের করছেন তিনি আর ঠাণ্ডা হতে মেলে দিচ্ছেন খােলা বাতাসে । প্রতিটি কাপের গায়ে তখন চমৎকার সাদা পালিশ ধরেছে । দেখে আর চোখ ফেরানাে যাচ্ছে না । 

       নিজের দৃঢ় মনােবল আর অমানুষিক পরিশ্রমের পুরস্কার পেলেন প্যালিসি । 

      তার উৎসাহ আরাে বেড়ে গেল । ঠিক করলেন প্রচুর বাসন এভাবে পালিশ লাগিয়ে পুড়িয়ে বিক্রি করবেন । সুন্দর জিনিসগুলাে সহজেই পছন্দ করবে লােকে । প্রচুর লাভ হবে তার ব্যবসায় । কিন্তু কাজটি মােটই সহজ ছিল না । একজন কুমােরকে দিয়ে নিজের মনের মতাে ডিজাইনের বেশ কিছু বাসন তৈরি করালেন প্যালিসি । কিন্তু চুল্লীতে দেবার পর আগুনের তাপে চুল্লীটাই ফেটে গেল আর বাসনগুলােতে কালি ঝুলির দাগ পড়ে সেগুলাে একেবারে বিশ্রী হয়ে গেল । 

       এবারেও ধৈর্য হারালেন না প্যালিসি । হাল ছাড়লেন না । পরম ধৈর্য সহকারে আবার চুল্লিটি মেরামত করে নিলেন । তারপর বাসনগুলাে ভেঙে আবার নতুন বাসন গড়ালেন ।

       কিন্তু হায় রে ! আবার যেই না সেগুলােকে চুল্লীতে ঢুকিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দিলেন— আবার ফেটে গেলাে চুল্লী । বার বার এরকম চলতেই লাগল ।

       কিন্তু কিছুতেই হাল ছাড়লেন না প্যালিসি । লােকে তাকে দেখলেই পাগল বলে খেপাত । স্ত্রী পুত্র পর্যন্ত তার ধারে কাছে ঘেঁষত না । সেই অবস্থার মধ্যেও সারাদিন বাগানে রােদ , বৃষ্টির মধ্যেও বসে বসে নিজের কাজ করে যেতেন । টানা ষােলােটি বছর এরকম সাধনা চালাবার পর অবশেষে সফল হলেন প্যালিসি । ফ্রান্সের রাজা খুশি হয়ে নানা পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত করলেন তাঁকে । জয় হল ধৈর্য , নিষ্ঠা ও অক্লান্ত অধ্যবসায়ের ।

         Do not give way , hold tight . It is when everything seems lost that all is saved .

                                                     - The Mother

0 Comments: