কালিদাস
মহাকবি কালিদাসের নাম শুধু তোমরা কেন পৃথিবীর যে কোনাে শিক্ষিত ব্যক্তিই শুনেছেন । অনেকেই পড়েছেন তাঁর কাব্য । বিশ্বের পণ্ডিত ব্যক্তিরা একবাক্যে স্বীকার করেছেন কালিদাসের লেখা অভিজ্ঞান শকুন্তলম , মেঘদূত , কুমারসম্ভব প্রভৃতি কাব্য- অপূর্ব , বিশ্বের সেরা সাহিত্যের অন্যতম ।
এহেন মহাপণ্ডিত মহাকবি কালিদাস যে প্রথম জীবনে একজন আকাট মূর্খ লােক ছিলেন তা বােধহয় অনেকেই জান না ।
কালিদাসের জীবনের সেই উত্তরণের গল্প যেমন আশ্চর্য তেমনি শিক্ষণীয় ।
বর্তমানে মধ্যপ্রদেশ রাজ্যের উজ্জয়িনী ছিল গুপ্তরাজ চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্যের রাজধানী । ঐতিহাসিকরা গুপ্ত যুগকে বলেন ভারতের সুবর্ণ যুগ , শিল্পে , সাহিত্যে , দর্শনে , বিজ্ঞানে , বাণিজ্যে সব বিষয়েই চরম সাফল্য এসেছিল এই যুগে । পুরুষরা তাে বটেই পরিবারের মেয়েরাও লাভ করতেন উচ্চশিক্ষা । তাদের সবাই খুব সম্মানও করত ।
উজ্জয়িনী রাজ্যেরই কোনাে এক রাজকন্যা ছিলেন রত্নাবলী । তিনি যেমন সুন্দরী তেমনি বিদূষী । দেশবিদেশের রাজপুত্ররা আসত তাঁকে বিয়ে করতে , কিন্তু রাজকন্যা তাদের তর্কযুদ্ধে হারিয়ে একেবারে নাস্তানাবুদ করে ছেড়ে দিতেন । দিনের পর দিন বড়াে বড়াে রাজা , রাজপুত্রেরা বিদূষী রাজকন্যার বিদ্যাবুদ্ধির কাছে গােহারা হারতে হারতে একসময় জোট বাঁধলেন । সবাই মিলে ঠিক করলেন রাজকন্যার বিদ্যার অহংকার ভাঙতেই হবে । প্রতিশােধ নেওয়ার জন্য তারা গভীর ষড়যন্ত্র করে এক আকাট মূর্খ দরিদ্র ব্যক্তির সঙ্গে রাজকন্যার বিয়ে দিয়ে দিলেন । ওই ব্যক্তি আর কেউ নন স্বয়ং কালিদাস ।
যাই হােক , বিয়ে তাে হয়ে গেল । কিন্তু বাসর রাত্রেই স্বামীর সঙ্গে আলাপ করতে গিয়ে রাজকন্যা বুঝতে পারলেন একজন গণ্ড মুখের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে তাঁর । বুঝতে পারলেন অপমানিত প্রত্যাখাত রাজপুত্রেরা এভাবেই প্রতিশােধ নিয়েছে । কিন্তু তাই বলে একজন গণ্ড মূর্খকে স্বামী বলে সারাজীবন মেনে নিতে হবে— এ ব্যবস্থাও তিনি মেনে নিতে পারলেন না । অপমান করে সেই রাত্রেই স্বামীকে রাজপ্রাসাদ থেকে তাড়িয়ে দিলেন রত্নাবলী ।
মূর্খ হলেও স্ত্রীর এই অপমানে মর্মান্তিক দুঃখ পেলেন কালিদাস । তিনি ভাবলেন এই লাঞ্ছিত জীবন তিনি আর রাখবেন না । বেশ তাে ছিলেন তিনি । মূর্খ হােন , দরিদ্র হােন নিজের মতােই ছিলেন । রাজপুত্ররাই তাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে কৌশলে রাজকন্যার সঙ্গে বিয়ে দিয়েছেন । এবার বন্ধুবান্ধব , আত্মীয়স্বজন কারাে কাছে কি তিনি আর মুখ দেখাতে পারবেন ? সবাই বিদ্রুপ করবে , করুণা করবে , মজা দেখবে ; নাঃ এ ঘৃণিত জীবন আজ রাতেই ওই নদীর জলে ডুবে ত্যাগ করবেন তিনি ।
মাথা নীচু করে একমনে উজ্জয়িনীর রাজপথ ধরে হেঁটে চলেছেন কালিদাস । বুকের মধ্যে দাউ দাউ করে জ্বলছে অপমানের তীব্র জ্বালা । চলতে চলতে একসময় শিপ্রা নদীর তীরে এসে দাঁড়ালেন তিনি । সামনে , একটু নীচেই পাহাড়ের কোল বেয়ে বয়ে চলেছে শিপ্রা । স্নিগ্ধ , শীতল , গভীর কালাে জল তার । কালিদাসের মনে হল যেন সেই জল মায়ের মতাে পরম মমতায় হাতছানি দিয়ে তাকে ডাকছে । যেন তার স্নিগ্ধ শীতল স্পর্শেই সব জ্বালা , সব লজ্জা জুড়িয়ে যাবে তার এখনি । পাথরে পাথরে পা রেখে , পায়ে পায়ে নীচে নেমে এলেন কালিদাস । পায়ের কাছে জল । জলের একেবারে কোল ঘেঁসে পড়ে থাকা একটা বড়াে পাথরের খণ্ডের ওপর একটু বসলেন কবি । জলের স্পর্শে আর নদীর ঠাণ্ডা বাতাসে মনের ভার একটু হাল্কা হয়ে এল তার । মনে পড়ল— বাপ মায়ের কথা । মনে পড়ল শৈশবের সাথীদের কথা । দুচোখ জ্বালা করে উঠল তাঁর । ঝর ঝর করে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল দুগাল বেয়ে । পরনের কাপড় দিয়ে দুচোখ মুছে চুপ করে বসে বসে ভাবতে লাগলেন । তিনি ছােটবেলাকার নানা কথা ।
চারিদিকে ইতস্তত ছড়ানাে আছে ছোটো বড়াে নানা আকারের পাথর । এদের মধ্যে একটা বেশ বড়াে পাথরের দিকে চোখ পড়তে বেশ অবাক হয়ে গেলেন কালিদাস । পাথরটা অন্য পাথরগুলাের তুলনায় বেশ মসৃণ , চওড়া আর ঝকঝকে পরিষ্কার । কালিদাস আপন মনে বসে বসে ভাবতে লাগলেন কেন এমনটা হল । অন্য পাথরগুলাে এমন এবড়াে খেবড়াে অথচ এই পাথরটা হঠাৎ এতাে মসৃণ হলাে কেমন করে ?
হঠাৎ বিদ্যুত চমকের মতাে তার মনে পড়ে গেল একদিনের কথা । আনমনে নদীর তীরে বেড়াতে বেড়াতে সেদিন তিনি দেখেছিলেন পল্লীর মেয়েরা দলবেঁধে নদী থেকে জল নিতে এসেছে । সেদিন তারা যখন বসে বসে গল্প করছিল কিংবা নদীতে স্নান করতে করতে সাঁতার কাটছিল , তখন তাদের জলভরা পিতলের কলসীগুলাে তাে ওখানেই ওই বড়াে পাথরটার ওপরেই রাখা ছিলাে । দিনের পর দিন এভাবেই রাখতে রাখতে ঐখানে পাথর ক্ষয়ে গিয়ে ওরকম মসৃণ আর পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে । অন্য পাথরগুলাের মতাে তার ওপর কোথাও একটি ফোটাও শেওলা জমে নেই ।
কালিদাস ভাবতে লাগলেন বসে বসে । দিনের পর দিন , বছরের পর বছর কলসী রাখতে রাখতে একসময় রুক্ষ পাথর ও ক্ষয়ে গিয়ে মসৃণ হয়ে গেল । তাহলে মানুষের মগজ কি পাথরের চেয়েও কঠিন ? দিনের পর দিন চেষ্টা চালিয়ে গেলে তিনিও কি মূর্খ কালিদাস থেকে পণ্ডিত কালিদাস হয়ে উঠতে পারবেন না ?
সেদিন শেষরাত্রে বাড়ি ফিরলেন তিনি । দরিদ্র পল্লী , পাতার কুটির । নিঃশব্দে নিজের ঘরে প্রবেশ করে দ্বার বন্ধ করে দিলেন তিনি । শুরু হয়ে গেল নীরব সাধনা । সবার অগােচরে । একে একে সমস্ত শাস্ত্র পাঠ করে সবার অলক্ষ্যেই মহাপণ্ডিত হয়ে উঠলেন তিনি । মুখে মুখে রচনা করতে লাগলেন অপূর্ব সুন্দর সব শ্লোক । ভূর্জ পত্রের ওপর শরের কলম দিয়ে একে একে রচনা করতে লাগলেন ঋতুসংহার , কুমারসম্ভব , বিক্রমাের্বশী , মেঘদূত , শকুন্তলা ।
প্রতিভা কখনাে চাপা থাকে না । একদিন সম্রাট বিক্রমাদিত্যের কানে ঠিক পৌছে গেলাে তার কথা । সাদরে মহাকবিকে ডেকে নিজের সভায় বরণ করে নিলেন তিনি । কালিদাস হলেন- সম্রাটের নবরত্ন সভার সর্বশ্রেষ্ঠ রত্ন ।
আর রত্নাবলী ? ততােদিনে ভুল ভেঙেছে তার । ভেঙেছে বিদ্যার অহংকারও । মহাপণ্ডিত মহাকবি কালিদাসকে স্বামীত্বে বরণ করে নিয়ে ভাগ্যবতী রাজকন্যা নিজেকে ধন্য মনে করলেন ।
‘ নহি সুপ্তস্য সিংহস্য প্রবিশান্তি মুখে মৃগাঃ '
—ঘুমন্ত সিংহের মুখে হরিণ নিজে এসে প্রবেশ করে না ।
0 Comments: