ঝুলন গােস্বামী
বাঙালি মেয়েরা শান্তশিষ্ট ঘরােয়া আর অসাধারণ সহিষ্ণু এই হিসেবেই পৃথিবীতে পরিচিতি তাদের । কিন্তু তারা যে খেলাধুলােতেও পিছিয়ে যায় না— সমস্ত রকম সামাজিক , অর্থনৈতিক আর পারিবারিক বাধা ডিঙিয়ে উঠে আসতে পারে আন্তর্জাতিক আঙিনায়— সব্বাইকে হারিয়ে দিয়ে কেড়ে নিতে পারে শ্রেষ্ঠত্বের শিরােপা ঝুলন গােস্বামী তার উজ্জ্বল উদাহরণ । বিশ্বের দ্রুততম মহিলা বােলার ঝুলন বাঙালি মেয়ের ক্রিকেট খেলাকে বিশ্বের দরবারে নিয়ে গেছে । পরে এসেছে বিশ্বজয়ের মুকুট । বিশ্বকাপ মহিলা ক্রিকেটে , অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে প্রথম ম্যাচে পাকিস্তানকে ৫৭ রানে দুমড়ে মুচড়ে দিয়ে ১০ উইকেটে হারিয়ে দিলেন ক্যাপ্টেন ঝুলন গােস্বামী । চমকে উঠে ফিরে তাকালো পৃথিবী ।
একে বাঙালি , তায় মেয়ে । বাড়ির কেউই চায়নি ঝুলন ক্রিকেট খেলাকেই জীবনের লক্ষ্য করুক । কিন্তু ৫ ফুট ১১ ইঞ্চির ঢ্যাঙা মেয়েটা ছােটো থেকেই ডানপিটে স্বভাবের । পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে টেনিস বলে ক্রিকেট খেলত । কিন্তু এতাে ধীর বল করতাে ঝুলন যে প্রতিটা বলেই ছক্কা মেরে দিতে ওরা । এমনকি ছেলেরা বিরক্ত হয়ে তাকে বল করতেই দিত না । পাঠিয়ে দিত ব্যাটিং - এ । সেই থেকেই ঝুলনের মনে প্রতিজ্ঞা দানা বাঁধল- দ্রুত বল তাকে করতেই হবে । দেখিয়ে দেবে , যে ছেলেদের চেয়ে কোনাে অংশেই কম যায় না সে ।
মাত্র বছর ১৫ বয়স তখন মেয়েটার । কিন্তু সেই বয়সেই সে বুঝে গিয়েছিল যে স্বপ্ন শুধু দেখলেই হয় না , তার পিছনে ছুটেও যেতে হয় লাগাতার ।
তাই বাড়ির সবাইয়ের আপত্তির কাছে মাথা নিচু না করে সে শুরু করে দিল ট্রেনিং নেওয়া । নদীয়া জেলার চাকদায় বাড়ি । সেখান থেকে কলকাতায় এসে ট্রেনিং নিয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে সামান্য বিশ্রাম নিয়ে আবার পড়তে বসা । দৈনিক ৪০ কিলােমিটার পথ ট্রেনজার্নি করার পর শরীর ভেঙে পড়তে চাইত । কিন্তু ভেঙে পড়েন নি ঝুলন । হাল ছেড়ে দেন নি । বাড়িতে যাতে অশান্তি না হয় সেজন্য খেলার সাথে সাথে পড়াশােনাও ঝুলন চালিয়ে গেছেন সমান তালে । আর এই দুদিক সমানে চালাতে গিয়ে কী অমানুষিক পরিশ্রমই না করতে হয়েছে তাঁকে । ভাের সাড়ে চারটেয় ঘুম থেকে ওঠা । একটু দেরী হলেই ট্রেন ফেল হয়ে যেত । দেরী হয়ে যেত প্র্যাকটিসের হাজিরায় । শুনতে হতাে বকুনি । কিন্তু কিছুতেই দমাতে পারেনি ১৫/১৬ বছরের দামাল মেয়েটিকে । প্রতিদিন প্রায় পাঁচ ঘণ্টারও বেশি জার্নি করার পরও ক্লান্তি বিরক্তি বা হতাশাকে আমল দেননি একটি দিনের জন্য । ৮০ মাইল ট্রেন জার্নি , দীর্ঘ প্র্যাকটিসের পরিশ্রম সবকিছুর পরেও বাড়িতে ফিরেই উঠানের কুয়ে থেকে জল তুলে মুখ হাত ধুয়ে , সামান্য জলখাবার খেয়ে নিয়েই পড়তে বসে যেত আর পাঁচটা ছেলেমেয়ের মতাে । অথচ কতােই না ফারাক আর পাঁচজনের সঙ্গে ঝুলন গােস্বামী নামের মেয়েটার ।
নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান । টালির চালের অতি সাধারণ এই বাড়িতে গ্রাম্য পরিবেশে বড়াে হয়ে ওঠা একটা মেয়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হবার স্বপ্নই তাে দেখবে না সাহস করে ।
কিন্তু ঝুলন দেখেছিল । তার অদম্য জেদ আর সবকিছুকে ফেস করতে রাত্রী থাকার মানসিকতার কাছে একটা সময় হার মানতে হয়েছে সবাইকে । সামান্য লেখাপড়া , তারপর বিয়ে আর ঘরসংসার এই ছকে বাঁধা জীবনের বাইরে বেরিয়ে এসে সাধারণ ঘরের মেয়ে ঝুলন অসাধ্য সাধন করেছে ।
ট্রেনিং পিরিয়ড তাে শেষ হল । ঝুলনের পারফরম্যান্সও যথেষ্ট আশাব্যঞ্জক । কিন্তু দেশবিদেশে খেলতে যাবার জন্যে দরকার অর্থের । একথা মনে করিয়ে দিয়ে ঝুলনের বাবা মা বােঝালেন যতােদূর হয়েছে ওখানেই থাক । এর বেশি উঁচুতে ওঠা আর সম্ভব নয় । দেশের মাটিতেই থাকো সন্তুষ্ট হয়ে । ঝুলন বুঝলেন সমস্যার বাস্তবতা , কিন্তু হাল ছাড়লেন না ।
১৯৯৭ সালে কোলকাতার মাঠে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের মধ্যে মহিলাদের ক্রিকেট টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হল । ঝুলন দুচোখ ভরে দেখল সেই খেলা আর দেখতে দেখতে তার মনপ্রাণ উদ্দীপিত হয়ে উঠল এক অভিনব দৃঢ় প্রতিজ্ঞায়— না , যেমন করেই হােক ক্রিকেটটা খেলে যেতেই হবে । আর শুধু দেশের মাটিতেই সীমাবদ্ধ হয়ে থাকলে চলবে না , খেলতে হবে বিদেশের মাটিতেও । হারাতে হবে ওই বিদেশিনীদের । কি এমন খেলে ওরা ! ঝুলনের যথেষ্ট ক্ষমতা আছে ওদের পাল্লা নেবার ।
কিন্তু কোথাও থেকে বড়াে সুযােগ আসছে না কোনাে । কিন্তু তাই বলে হাল ছেড়ে দিল না ঝুলন । নিয়মিত প্র্যাকটিস চালিয়ে যেতে লাগল প্রতিদিন । শীত গ্রীষ্ম বর্ষা— বারােমাস একটি দিনের জন্য গ্র্যাকটিস বন্ধ থাকত না তার । এর মধ্যে ঘরােয়া ক্রিকেটে ঝুলন গােস্বামী ততােদিনে হয়ে উঠেছে একটি অতি পরিচিত নাম ।
বছর তিনেক অপেক্ষা করার পর হঠাৎ এসে গেল একটা সুযােগ । সেটা ২০০০ সালের কথা । ইস্টজোন ও এয়ার ইন্ডিয়ার মধ্যে খেলা ছিল । ঝুলন খেলছিল ইস্টজোনে । এয়ার ইন্ডিয়ার পক্ষে অঞ্জু জৈন সহ আরাে অনেক বাঘা বাঘা খেলােয়াড় । সেদিন বােধহয় স্বয়ং ঝড়ের দেবতা পবনদেব ভর করেছিল ঝুলনের বলে । মােট তেরাে ওভারে সে এয়ার ইন্ডিয়ার মতাে বলিষ্ঠ দলকে নিতে দিয়েছিল সাকুল্যে ১৩ রান এবং নিজের ঝুলিতে ভরে নিয়েছিল তিন তিনটি উইকেট । কর্তাব্যক্তিরা আর মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারলেন না । চোখের দৃষ্টি তাদের কেড়ে নিল ঝুলন । বহু উপেক্ষিত মহিলা ক্রিকেটার ঝুলন গােস্বামী ।
এমনিতেই আমাদের দেশটা খেলাধুলােকে খুব একটা গুরুত্ব বা মর্যাদা দেয় না । আজও এদেশের ছেলেমেয়েরা খেলােয়াড় হিসেবে ভবিষ্যৎ গড়ার স্বপ্ন দেখলে বাবা মা বুঝিয়ে সুঝিয়ে তাকে নিরস্ত্র করে ছাড়েন । তার কারণ একটাই , খেলে কেউ নামও করতে পারে না । টাকাও করতে পারে না- এক্কেবারে সেই প্রথম সারির দু - একজন ছাড়া । এদেশে খেলা বলতে যা কিছু মাতামাতি তা ফুটবল আর ক্রিকেট নিয়ে— তাও কেবলমাত্র পুরুষদের । মহিলাদের নয় । পত্রপত্রিকাগুলাে পাতার পর পাতা , নামী দামী খেলােয়াড়দের বিভিন্ন পােজের ছবি আর তাদের খেলা না খেলা ক্রীড়ামুহূর্তের চর্বিত চর্বন— এই নিয়েই ব্যস্ত থাকে । ঝুলনদের মতাে খেলােয়াড়দের জন্য এক তিল জায়গা বরাদ্দ করে না তারা । নিতান্ত বড়াে কোনাে জয়ের পর ১০/১২ লাইনের ছােট্ট একটি স্তম্ভে দায়সারা একটি খবর । সঙ্গে না ছবি— না কিছু , না বিশেষজ্ঞ কোনাে প্রবীণ ক্রিকেটারের মতামত । মেয়ে ক্রিকেটার যেন বিমাতার সন্তান । একই খেলা , একই সংগ্রাম , একই মর্যাদাপূর্ণ জয়— তবু পুরুষ ক্রিকেটার ও মহিলা ক্রিকেটারের মধ্যে এই আকাশপাতাল ফারাক এক একসময় বিরক্ত আর হতাশ করে তােলে ঝুলনকে চরম ভাবে । কিন্তু তাতেও কখনােই হাল ছাড়েন না তিনি ।
যাই হােক , সেবার ইষ্টজোনের হয়ে সেই দুর্ধর্ষ খেলায় কর্তৃপক্ষের চোখে পড়ে গেছেন ঝুলন । তারই ফলশ্রুতি স্বরূপ ২০০২ সালে ইংল্যান্ড যাত্রার সুযােগ পেয়ে গেলেন । পরবর্তীকালে অস্ট্রেলিয়া সফর এবং ২০০৫ - এ বিশ্বকাপ খেলার সুযােগও পেয়েছেন ঝুলন । সেই ২০০২ থেকে শুরু করে ক্রমাগত এগিয়ে চলেছেন ঝুলন । ভারতের হয়ে বিদেশের মাটিতে খেলতে নেমে চাকদার এক অজ্ঞাত পল্লীর এই দুর্দান্ত জেদী একরােখা মেয়েটি বারবার তার প্রতিপক্ষকে বুঝিয়ে দিয়েছে কতােখানি শক্তি ধরে এই দীর্ঘাঙ্গিনী বঙ্গকন্যার বাহু । বর্তমান বিশ্বের এই দ্রুততম মহিলা বােলারকে মুম্বই - এর ক্রিকেট এ্যাকাডেমি সম্প্রতি ক্যাসটুল পুরস্কারে ভূষিত করেছে । ঝুলন গােস্বামীর দুঃসাহসী সাধনা পৌছে গেছে । সাফল্যের উপকূলে । মাত্র ২২ বছর বয়স তার । এরই মধ্যে বাহুতে ঝড়ের গতি । ঘণ্টায় ১২০ কিমি বেগ তার বলের যার সামনে তাসের ঘরের মতাে ভেঙে পড়ে বিপক্ষের উইকেট একের পর এক । না , তার জন্য কোনাে নামীদামী বিদেশি কোচ রাখা হয়নি ঠিকই কিন্তু প্রতিবার ভারতের হয়ে বিদেশের মাটিতে পা রাখার আগে ঝুলন ছুটে গেছেন । চেন্নায়ের M. R. F পেস একাডেমিতে । ডেনিস লিলি ( অস্ট্রেলিয়ার কিংবদন্তী বােলার ) র সঙ্গে দেখা করে তার থেকে নিয়েছেন উপদেশ ও প্রয়ােজনীয় টিপস । নিরন্তর সাধনা ও প্রবীণের পরামর্শ— এই টুকুমাত্র সম্বল করে ঝুলন ক্রমাগত এগিয়ে চলেছেন । ২০০৯ সালের মার্চে , অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে দাঁড়িয়ে দু দুটি ম্যাচে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে দিয়ে । ঝুলন প্রমাণ করেছেন বাঙলার এক সামান্য মেয়ে হয়েও তিনি কতােখানি অসামান্য । দারিদ্র , উপেক্ষা , বঞ্চনা— সবকিছুকে বুড়াে আঙুল দেখিয়ে স্থির লক্ষ্যের পথে দৃঢ় মুষ্টিবদ্ধ ঝুলন গােস্বামী এগিয়ে চলেছেন ।
" মেঘ দেখে কেউ করিস নে ভয় আড়ালে তার সূর্য হাসে । হারা শশীর হারা হাসি অন্ধকারেই ফিরে আসে ।"
- রবীন্দ্রনাথ
0 Comments: