বিঠোফেন
পৃথিবীর মানুষ তাঁকে চেনে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সুরকার হিসেবে । পুরােনাম লাডুইগ ভন বিঠোফেন । হাজার হাজার দর্শক ঘণ্টার পর ঘণ্টা মন্ত্রমুগ্ধের মতাে শুনতাে তাঁর পিয়ানাের সুর আর বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যেত । আজও তার সিম্ফনীগুলি বিশ্বের যে কোনাে সুররসিক ব্যক্তির কাছে এক অমূল্য সম্পদ । সে সুর শােনা এক অনির্বচনীয় অভিজ্ঞতা ।
কিন্তু ভাবতে পার ? অদৃষ্টের এমনই পরিহাস যে সারা পৃথিবী যাঁর সুরে মুগ্ধ সেই বিঠোফেন নিজেই কখনাে শুনতে পাননি তার নিজের রচিত শ্রেষ্ঠ সঙ্গীতগুলাে । কারণ তার আগেই তিনি সম্পূর্ণ বধির হয়ে গিয়েছিলেন । কিন্তু হাল ছাড়েন নি । নির্মম ভাগ্যের কাছে নতিস্বীকার করেন নি । বরং আরাে নিষ্ঠা , আরাে একাগ্রতার সঙ্গে মগ্ন হয়ে গিয়েছিলেন সঙ্গীত সাধনায় ।
১৭৭০ সালে জার্মানীতে জন্ম বিঠোফেনের । সঙ্গীত শিল্পী বাবার কাছেই পিয়ানােয় হাতে খড়ি তার । মাত্র ২/৩ বছর বয়স থেকেই বাবার দেখাদেখি দিনরাত পিয়ানাে নিয়ে নাড়াচাড়া করতেন । খেলাচ্ছলে যেমন খুশি আঙুল চালাতেন পিয়ানাের বুকে । আর এমনি করতে করতেই কখন সবার অজ্ঞাতে বিঠোফেন হয়ে দাঁড়ালেন একজন পাক্কা শিল্পী । মাত্র দশ বছর বয়সেই সারা দেশে খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল তার ।
হঠাৎ মা মারা গেলেন । বাবা তাকে পাঠিয়ে দিলেন বাের্ডিং স্কুলে । সেই স্কুলেই একদিন বিঠোফেনের দেখা হয়ে গেল বিখ্যাত সুরকার যােশেফ হেডেনের সঙ্গে । যােশেফ বিঠোফেনের বাজনা শুনে অবাক হয়ে গেলেন ।
এরপর যােশেফের পরামর্শে ভিয়েনায় চলে এলেন বিঠোফেন । ভিয়েনা সঙ্গীতের পীঠস্থান । যােশেফের সাহায্যে একের পর এক রচনা করতে লাগলেন আশ্চর্য সব শিম্ফনী । ভিয়েনায় গুণগ্রাহীর অভাব নেই । হাজার হাজার শ্রোতা টিকিট কেটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মুগ্ধ হয়ে বসে । এইসব শিম্ফনী বা সুরলহরী শুনে যেত আর বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে ভাবত এমন স্বর্গীয় সুর এতােটুকু একটা ছেলের হাত থেকে বের হওয়াও কি সম্ভব ?
সহসাই দুর্ভাগ্য নেমে এলাে বিঠোফেনের জীবনে । এমন দুর্ভাগ্যের কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি বিঠোফেন । ফিফথ ও সিক্সথ শিম্ফনী রচনার সময় তিনি বুঝতে পারলেন যে একটু একটু করে বধির হয়ে যাচ্ছেন । যা বাজাচ্ছেন তার সবটুকু যেন তার কানে পৌছচ্ছে না । যেন দূর থেকে ভেসে আসা পথিকের গানের মতাে তা ক্রমশ একটু একটু মিলিয়ে যাচ্ছে দূর থেকে আরাে দূরে ।
বাচ্চা হলেও বুদ্ধিমান বিঠোফেন বুঝতে পারলেন কি হতে চলেছে । কিন্তু ভেঙে পড়লেন না । একজন শিল্পী যদি সুর শুনতেই না পায় তবে কেমন করে সৃষ্টি করবে সে ?
তবু হাল না ছেড়ে দিনের পর দিন আরাে বেশি সময় দিয়ে মগ্ন হয়ে রইলেন সুরে । প্রতিটি নােট বা স্বরলিপির সুর যেন হৃদয়ের মধ্যে একেবারে গেঁথে নিতে চাইলেন যাতে কোনাে ভুল না হয় ।
সপ্তম অষ্টম শিম্ফনী রচনা হয়ে গেল অতি দ্রুততার সঙ্গে । কিন্তু নবম সিম্ফনী রচনা শেষ হবার আগেই সম্পূর্ণ বধির হয়ে গেলেন তিনি ।
তবু থামলেন না । সম্পূর্ণ আন্দাজে ধীরে ধীরে আত্মবিশ্বাসে ভর করে শেষ করলেন নাইনথ শিম্ফনী ।
কাজ শেষ করে বিষন্ন শান্ত মনে বসেছিলেন বিঠোফেন । কাউকে ডেকে শােনাবার কথা মনে হবার আগে ভাবছিলেন কি জানি কেমন হয়েছে এই গান । হয়তাে শ্রোতারা শুনে বলবে বিঠোফেনের আগের সৃষ্টির তুলনায় এটি একেবারেই নিকৃষ্ট হয়েছে । অন্যদিকে আত্মবিশ্বাসী মনটি বলল- না না- হৃদয়ের সুরে বাঁধা সঙ্গীত , মানুষের ভালাে লাগবেই লাগবে ।
যাই হােক , ফুলের সুরভী চাপা থাকে না । মানুষ বিঠোফেনের নাইনথ শিম্পনী শুনল এবং সবাই একবাক্যে বলল- এইটাই বিঠোফেনের সমস্ত শিম্ফনী মধ্যে শ্রেষ্ঠ । অন্য কিছু না করে বিঠোফেন যদি শুধু এই নাইনথ শিম্ফনী টুকুই রচনা করতেন তা হলেও জগতে তিনি অমর হয়ে থাকতেন । ঠিক যেমন অমর হয়ে আছেন আজ , সরস্বতীর বরপুত্র বধির বিঠোফেন । বধির হয়েছিলেন বলেই বিশ্বসংসারের কল কোলাহল থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ দূরে সরিয়ে এনে একটি মাত্র বিষয়ের প্রতি পুরােপুরি মগ্ন হতে পেরেছিলেন । আর তাই পেয়েছিলেন সাধনায় অভূতপূর্ব সিদ্ধি ।
' Every cloud has a silver line !'
0 Comments: