রামদুলাল দে
স্বাধীন ভারতবর্ষের অন্যতম সফল ব্যবসায়ী ছিলেন এই বাঙালি রামদুলাল দে ।
পিতৃমাতৃহীন বালক রামদুলাল শৈশবেই চলে আসেন মামার বাড়ি । দাদামশাই বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা করেন আর দিদিমা রান্না করেন লােকের বাড়ি ।
সারাদিনের শেষে বাড়ি ফিরে দাদামশাইয়ের আনা পাঁচমিশেলি ভিক্ষে করা চাল ফুটিয়ে দিতেন দিদিমা । তাই মনে হতাে যেন অমৃত । এভাবেই শুরু হয়েছিল যার জীবন , যৌবনে তিনি পরিচিত হয়েছিলেন বাংলার রথচাইল্ড ( একজন শীর্ষস্থানীয় ধনী ইংরেজ ) নামে ।
দৃঢ় প্রতিজ্ঞা , সততা , নিষ্ঠা আর বিনয়- এই চারটি চারিত্রিক গুণকে মাত্র সম্বল করে উনবিংশ শতকের রামদুলাল দে এই অসাধ্য সাধন করেছিলেন ।
না লেখাপড়া শেখার কোনাে সুযােগ তিনি পাননি । ইংরেজি অক্ষর লিখতে পারতেন না । কিন্তু স্বশিক্ষিত রামদুলালের ইংরেজি বলতে বা শুনে বুঝতে কোনাে অসুবিধা হত না । তাই চীন , জাপান , ইংল্যান্ড , আমেরিকা সহ প্রায় সারা পৃথিবী জুড়েই ছড়িয়ে পড়েছিল তার কোম্পানির ব্যবসাবাণিজ্য । বাঙালি তথা ভারতবাসী তাকে আজ বেমালুম ভুলে গেছে কিন্তু আমেরিকা ভােলেনি । সেখানকার ‘ রামদুলাল সােসাইটি ’ তার প্রমাণ ।
কিভাবে এমন যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটাতে পেরেছিলেন জীবনে রামদুলাল দে ? সে যেন এক আশ্চর্য রূপকথার গল্প । যে কোনাে হাড় কাপানাে ইংরেজি থ্রিলারের চেয়ে কিছু কম রােমাঞ্চকর নয় ।
রামদুলালের দিদিমা যার বাড়িতে রান্নার কাজ করতেন তিনি হলেন মদন মােহন দত্ত কলকাতার একজন মাঝারি মাপের ব্যবসায়ী । কলকাতা বন্দরে আসা জাহাজ ভর্তি মাল নিলামে কিনে তা বিক্রি করে মােটা টাকা মুনাফা করত তার কোম্পানি । এই মদনমােহন দত্তের আউট হাউসে রামদুলাল থাকতেন তার রাঁধুনী দিদিমার সঙ্গে ।
ধনীর আশ্রিত বালক । তাকে খরচপত্র দিয়ে পাঠশালায় পড়তে পাঠানাের প্রশ্নই ওঠে না । দিদিমা কাজে বেরিয়ে যাবার পর বালক রামদুলাল পায়ে পায়ে চলে যেতেন পাড়ার পাঠশালার কাছে । চুপ করে বসে থাকতেন আটচালার বাইরে , পথের ধারে । ছাত্ররা কলাপাতার ওপর কঞ্চির কলম দিয়ে লেখা অভ্যাস করত । তারপর ছুটির সময় লেখা কলাপাতাগুলাে ফেলে দিত বাইরে ছুঁড়ে । রামদুলাল সেগুলি সযত্নে কুড়িয়ে রেখে দিতেন । অস্পষ্ট হয়ে যাওয়া লেখাগুলির ওপর বুলিয়ে বুলিয়ে অভ্যাস করতেন নিজে নিজে । তারপর পাতাগুলি জলে ধুয়ে এনে নিজের হাতে আবার নতুন করে লিখতেন । মিলিয়ে নিতেন অন্য লেখার সঙ্গে ঠিক হলাে কিনা ।
এভাবেই চলছিল অক্ষর জ্ঞান । ধনী বালকের ছেড়া পরিত্যক্ত বইখাতা দেখে দেখে পড়তেও শিখলেন বাংলা । তার মেধার পরিচয় পেয়ে এবং বিনয়ী নম্র ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে বাড়ির মালিক মদনমােহন দত্ত তাকে পাঁচ টাকা মাইনের বিল সরকারের চাকরি দিলেন । কিন্তু ভিক্ষান্নে পালিত রামদুলালের মনের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ওই পাঁচ টাকা ( এখনকার হিসেবে প্রায় ৭০০০ টাকা ) মাইনেতেই এসে থামতে পারল না। একদিন রামদুলাল তার প্রভুর বিনা অনুমতিতে প্রভুর ১৪,০০০ টাকা খাটিয়ে এক ডুবােজাহাজ নিলামে ডেকে নিলেন । কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ওই জাহাজের সব মাল বিক্রি হয়ে গেল এক লাখ চোদ্দ হাজারে । লাভের এই এক লাখ টাকা রামদুলাল নিঃশব্দে আত্মসাৎ করে নিতে পারতেন । কিন্তু করলেন না । সবিনয়ে পুরাে টাকাটাই তুলে দিলেন মনিবের হাতে ।
এই বিশ্বাসের সম্মান দিলেন মদনমােহন দত্ত । তিনি ওই এক লাখ টাকা ( বর্তমানে ১৪,০০০০০০ - এককোটি চল্লিশ লাখ ) রামদুলালকে দিয়ে তাকে নিজের স্বাধীন ব্যবসা করতে বললেন । সেই শুরু তারপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি রামদুলালকে । কোটি কোটি টাকা উপার্জন করেছেন জীবনে । কিন্তু নিজের ভিক্ষান্ন । লালিত শৈশবের কথা একটিবারের জন্যও ভােলেন নি তিনি । তাই সারাজীবন সাদাসিধে অসাড়ম্বর জীবনযাপন করে গেছেন আর দুই হাতে করে গেছেন দান ধ্যান । দারিদ্র্যের যন্ত্রণা যে কি তিনি জানতেন । জানতেন অনাহারের কষ্ট ।
তাই প্রতিমাসে চারশাে দরিদ্র প্রতিবাসীকে তিনি চাল , ডাল ও বাজার খরচের জন্য টাকা দিতেন । প্রতিদিন তার অফিসে দলে দলে লােক আসত সাহায্য প্রার্থনা করতে । তাদের জন্য দৈনিক সত্তর টাকা বরাদ্দ ছিল । কর্মচারীদের অবসরের পর পেনশানের ব্যবস্থা তিনিই প্রথম প্রচলন করেন । এছাড়া তিনজন পাশ করা ডাক্তার নিযুক্ত করা ছিল । তারা কর্মচারীদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে ঘুরে তাদের চিকিৎসা করতেন ও ওষুধ পথ্য সরবরাহ করতেন ।
বিশাল অতিথিশালা সেখানে জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে এক হাজার অতিথি প্রতিদিন পেটপুরে খেতে পায় । এমনকি মৃত্যুর সময়েও রামদুলাল দু লাখ টাকা আলাদা করে রেখে যান , দরিদ্র অতিথি সেবার জন্য । রামদুলালের জীবনসংগ্রামের পিছনে সম্ভবত একটাই উদ্দেশ্য দৃঢ়ভাবে কাজ করেছিল তা হল দরিদ্রদের সাহায্য করা । হাজার হাজার বেকারকে চাকরি দিয়ে , লক্ষ লক্ষ দরিদ্রের মুখে অন্ন দিয়ে তিনি জীবনকে সর্বার্থেই সার্থক ও সফল করে তুলেছিলেন । তাই তার সংগ্রাম ও সফলতা আজ কিংবদন্তী ।
To accomplish great things we must dream visualize , plan , believe and act .
0 Comments: