মাসদুর রহমান
ঘট ঘটাং ঘট ঘটাং শব্দ করতে করতে ইস্পাত বাঁধানাে লাইনের ওপর দিয়ে বেগে ধেয়ে আসছে একটা মালগাড়ি । সেদিকেই স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে চুপ করে বসেছিল ছেলেটি গাছের ডালে । রেললাইনের ঠিক পাশেই ঝাকড়া গাছ । গাড়ি গাছের কাছে এলেই এক লাফে ঝাঁপিয়ে পড়বে গাড়ির ছাদে । তারপর স্কুলের কাছ বরাবর এসেই আর একটা লাফ দিয়ে নেমে পড়তে হবে । এই ছিল তার প্ল্যান । পাড়াগাঁয়ের ছেলে । লাফঝাপ মারাতে ভয় দূরে থাক প্রচণ্ড উৎসাহ তার ।
প্রায় ২ কিমি দূরে ছেলেটির স্কুল । প্রতিদিন যাতায়াতে প্রায় আধঘণ্টা সময় লাগে । কিন্তু সেদিন বাড়ি থেকে বের হতেই দেরী হয়ে গেছে । তাই ছেলেটি মাথা খাটিয়ে এক বুদ্ধি বার করল । মালগাড়ির ছাদে একবার চেপে বসতে পারলে আর চিন্তা নেই । মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই অনায়াসে পৌছে যাওয়া যাবে ২ কিমি পথ । সময়ও বাঁচবে , স্কুলেও বকুনি খেতে হবে না । ক্রমে একেবারে কাছে এসে পড়ল মালগাড়িটি । ছেলেটি সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে পড়ল ছাদে । কিন্তু চলন্ত গাড়ির বেগের সঙ্গে তাল রাখতে না পেরে পা হড়কে পড়ে গেল লাইনের ওপর । মালভর্তি ভারী গাড়ির চাকা একের পর এক গড়িয়ে চলে গেল তার দুটি পায়ের ওপর দিয়ে । হাসপাতালে নিয়ে যাবার পর দুটি পা - ই হাঁটু থেকে অপারেশন করে বাদ দিতে হল । জন্মের মতাে পঙ্গু হয়ে গেল ছেলেটি ।
গরিব ঘরের পঙ্গু খোঁড়া ছেলে । সবাই একবাক্যে বলল বাকি জীবনটা ভিক্ষে করে খেতে হবে ওকে । হ্যা , ভিক্ষে করে কারণ এভাবেই এই ভারতবর্ষের লক্ষ লক্ষ প্রতিবন্ধী মানুষ নিজেদের পেট চালাতে বাধ্য হয় ।
কিন্তু না । আমাদের গল্পের এই নায়ক কিন্তু কিছুতেই এই অমােঘ ভবিতব্যকে মেনে নিতে চায়নি । ভিক্ষে নয় , এক সুস্থ , স্বাভাবিক , সসন্মান জীবনই গড়ে তুলব আমি প্রতিজ্ঞা করল সে মনে মনে । আজ সারা বিশ্বের মানুষ সবিস্ময়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে , তার নামে । জয়ধ্বনি দেয় । বিশ্বের বুকে স্বদেশের বিজয় পতাকা উড়িয়ে দিয়েছে , সেদিনের সেই পঙ্গু মূখ পল্লী বালকটি ।
এতােক্ষণে নিশ্চয়ই ছেলেটিকে চিনতে পেরেছাে তােমরা ? হ্যা , ইনিই বিখ্যাত সাঁতারু , ইংলিশ চ্যানেল , জিব্রালটার প্রণালী সহ পৃথিবীর নানা দুরূহ সমুদ্রযােজক বিজয়ী বীর বঙ্গসন্তান— মাসদুর রহমান বৈদ্য । তীব্র ইচ্ছাশক্তি আর গভীর আত্মবিশ্বাসের কাছে যে পৃথিবীর কোনাে বাধাই বাধা নয়- একথা বিশ্ববাসীকে আরাে একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন মাসদুর ।
মাসদুর রহমান বৈদ্য , শৈশবে যখন দুর্ঘটনায় নিজের দুটি পা হারালেন তখন তার বাবা - মা সহ পরিবারের সবাই হতাশায় ভেঙে পড়লেন । কিন্তু স্বয়ং মাসদুর নিজে হাল ছাড়লেন না কিছুতেই । জেদ চেপে গেল মনে । সুস্থভাবে বাঁচতেই হবে , স্বাভাবিকভাবেই হাঁটাচলা করতেই হবে । লােকে যখন তার দিকে করুণার দৃষ্টিতে তাকাতে , আহারে ! খোঁড়া বেচারা ! বালে অনুকম্পা প্রকাশ করত কিংবা
বিজ্ঞাণ বাণে বিদ্ধ করত তখন কোনাে কোনাে সময় নিজেকে বড়াে দুর্ভাগা মনে হতাে তার । তার প্রতি এই অবিচার করার জন্য নিদারুণ অভিমান হাত ঈশ্বরের প্রতি । কখনাে বা নিজের অজান্তেই মনের অবচেতনে নিজেকে শেষ করে ফেলার ইচ্ছে জাগত ।
এমনি সময় একদিন একজন মানুষের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল মাসদুরের । সেও হারিয়েছে দুটি পা । তবু সে ভিক্ষাজীৰী নয় । অন্যের করুণার পাত্র নয় । নিজের স্ত্রী ও তিনটি কন্যাকে নিয়ে দিব্যি সংসার তার এবং সম্পূর্ণ একার রােজগারে সে - ই এই বৃহৎ পরিবারটির ভরণপােষণ করে । সমাজের আর পাঁচজন সুস্থ নাগরিকের মতােই সম্মানীয় স্বাভাবিক জীবন তার ।
নিজের চোখের সামনে এইরকম জীবন্ত উদাহরণ দেখে মাসদুর উজ্জীবিত হয়ে উঠলেন নতুন প্রেরণায় । পুণেতে গিয়ে লাগিয়ে নিলেন বিকল্প পা । ক্রাচ ফেলে দিয়ে নিজের পায়ের ওপর সােজা হয়ে দাঁড়ালেন । আকাশের দিকে দুই হাত তুলে বললেন আমি পারব আমরা পারব- আমরাও পারি । নকল প্রত্যঙ্গকে নিজের শরীরের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে গেলে প্রথম প্রথম খুব যন্ত্রণা হয় । এই যন্ত্রণা সহ্য করেই হাঁটাচলা করতে হয় । একটু একটু করে হাঁটাচলা করতে করতে নকল পা আসল পায়ের মতােই সহজ হয়ে ওঠে ।
মাসদুরের ক্ষেত্রেও তাই হল । অনেক যন্ত্রণা ও অভ্যাসের পর বিকল্প পা শরীরের সঙ্গে ঠিকভাবে সংযুক্ত হল । আর তারপর থেকেই শুরু হল মাসদুর রহমান বৈদ্যের বিশ্ববিজয়ের রথযাত্রা ।
ছােটো থেকেই খেলাধুলা করতে ভালােবাসতেন । পা ঠিক হবার পর ছােটোখাটো ক্রীড়া প্রতিযােগিতায় নাম দিতে লাগলেন । অনেকটা যেন নিজের প্রতিই নিজে ছুড়ে দিয়েছিলেন কঠিন চ্যালেঞ্জ । দেখি পারি কিনা , কেন পারব না— পারতেই হবে । এই কঠিন জেল নিয়েই নকল পা-ওলা মানুষটি সেবার যােগ দিলেন বড়ােসড়াে sports fourTinnerst এ । 17 টি ইভেন্টের মধ্যে 16 টিতেই জয়ী হলেন তিনি , তার মধ্যে চারটি ছিল সাঁতারের ইভেন্ট । সেদিন ভিকট্রি স্ট্যাম্পের ওপর দাঁড়িয়ে শত শত দর্শকের হাততালির সামনে পুরস্কার গ্রহণ করতে করতে একটাই প্রতিজ্ঞা মনের গভীরে রােপণ করলেন মাসদুর - সাঁতার , শুধু সাঁতারই এবার থেকে হবে তার লড়ায়ের অস্ত্র । এই নকল পা নিয়েই ইংলিশ চ্যানেল পার হতে হবে তাকে । দেখিয়ে দিতে হবে বিশ্বের মানুষকে যে প্রতিবন্ধী মানেই করুণার পাত্র নয় ঘৃণার পাত্র নয় । তারাও ছিনিয়ে নিতে পারে শ্রেষ্ঠের সম্মান , মাথায় পরতে পারে বিজয়ীর মুকুট ।
শুরু হল জোরদার অনুশীলন আর সেইসঙ্গে স্পনসর যােগাড় করার চেষ্টা । আমাদের এই হতভাগ্য দেশে আজও খেলাধুলার প্রয়োজনে বিদেশ যেতে হলে স্পনসরের অপেক্ষায় তাকিয়ে থাকতে হয় । কারো ভাগ্যে শিকে ছেড়ে , কারাে ভাগ্যে ছেড়ে না । তার প্রতিভা কুঁড়িতেই ঝরে যায় ।
যাইহােক , মাসদুর রহমানের ভাগ্য কিছুটা ভালাে ছিল । 1997 সালে ইংলিশ চ্যানেল সাঁতারে পার হয়ে গেলেন তিনি । এর আগে তার মতাে আর কোনাে প্রতিবন্ধী এই বিপদসংকুল সমুদ্রখাল সাঁতরে পার হতে পারেনি । 2001 সালে মাসদুরের মুকুটে যুক্ত হল আরাে একটি অত্যুজ্জ্বল পালক । 32 বছর বয়সী এই যুবক ভীষণতম তরঙ্গসংকুল জিব্রালটার প্রণালী মাত্র 4 ঘণ্টা 20 মিনিটে সাঁতরে পার হয়ে গেলেন । তার আগে পৃথিবীর আর কোনাে দুই পা হারানাে সাঁতারু এতাে বড়াে বিরল কৃতিত্বের অধিকারী হতে পারেনি ।
বর্তমানে মাসদুর রহমানকে নিয়ে একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হতে চলেছে । ডাইরেক্টর খােকন চক্রবর্তীর নির্দেশনায় । নাম আশা । প্রধান চরিত্রে অভিনয় করছেন মাসদুর রহমান নিজেই । শারীরিক প্রতিবন্ধী যে সমাজ ও পরিবারের বােঝা নয় , একটু সাহায্য বা সসম্মান সহযােগিতা পেলে তারাও যে প্রমাণ করতে পারে নিজেদের , এটাই এই চলচ্চিত্রের অন্তর্নিহিত বার্তা ।
এই সিনেমার গল্পে দেখানাে হয়েছে একজন মহিলা , প্রতিবন্ধী সন্তানের জন্ম দেওয়ার অপরাধে সমাজে ও পরিবারে এতােদুর অত্যাচারিত হয়েছেন যে দুঃখে হতাশায় আত্মহত্যা করতে উদ্যত হয়েছেন । মাসদুর রহমান তাকে শেষপর্যন্ত আত্মহত্যা থেকে বিরত করবেন এবং তার প্রতিবন্ধী সন্তানকেও পথ দেখাবেন সুন্দর আলােকিত জীবনের ।
মাসদুর কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করা সত্ত্বেও কোনাে পারিশ্রমিক নিচ্ছেন না এই ছবির জন্য । অমিতাভ বচ্চন অভিনীত ‘ ব্ল্যাক ’ ছবিটি দেখার পর তার মনে হয়েছে এ ধরনের ছবি আরাে বেশি বেশি করে তৈরি হওয়া প্রয়ােজন । তাই সহস্র ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি অভিনয়ের জন্য সময় বার করে নিয়েছেন । তুলে ধরতে চলেছেন নিজের অনবদ্য জীবনের রূপকথা কোটি কোটি দর্শকের সামনে । কোটি কোটি আশাহত হৃদয়ে হাল না ছাড়া , হার না মানা সঞ্জীবনী মন্ত্র ছড়িয়ে দেবার উদ্দেশ্যে ।
0 Comments: