মেঘনাদ সাহা
ভারতবর্ষে আজ পর্যন্ত যতােজন বিজ্ঞানী আন্তর্জাতিক মাপের পদার্পণ করেছেন তাদের কাউকেই মেঘনাদ সাহার মতো কষ্ট করতে হয়নি । সমাজের একেবারে নিচুতলায় , দারিদ্র্য অশিক্ষা আর ছুঁতমার্গের অভিশাপ যেখানে তিল তিল করে শেষ করে ফেলে মানুষের সমস্ত রকম সম্ভাবনাকে সেই একেবারে ধুলাে কাদার বুক থেকেই উঠে এসেছিলেন মেঘনাদ সাহা বিজ্ঞান ভারতীর সােনার সিংহাসনে । আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু , ড : সি ভি রমণ , সত্যেন্দ্রনাথ বসুর সঙ্গেই মেঘনাদ সাহার নামও সমান সম্মান ও বিস্ময়ের সঙ্গে স্মরণীয় । কিন্তু অন্যদের তুলনায় মেঘনাদ সাহার কৃতিত্ব অনেক বেশি এইজন্যই যে তিনি উঠে এসেছেন সমাজের এক অবিশ্বাস্য অন্ধকার স্তর থেকে অবিশ্বাস্য সাফল্যের আলােয় । জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে নানারকম বাধার মােকাবিলা করতে করতে একসময় শিখরে এসে পৌঁছেন এই বিজ্ঞান সাধক । সবদেশে সবকালের পিছিয়ে পড়া দলিত মানবশ্রেণীর সামনে এক চিরউজ্জ্বল প্রেরণার ধ্রুবতারা তিনি ।
মেঘনাদের বাবা ছিলেন এক গরিব মুদি । পাঁচটি ভাই আর বাবা মা সহ সাত আটজনের সংসার । আয়ের উৎস একমাত্র ঐ মুদির দোকানটুকু । মেঘনাদ যখন গাঁয়ের স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করলেন তখনই তার বাবা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন আর লেখাপড়া শিখে কি হবে ! এবার থেকে ও মুদির দোকানেই বসুক বড়াে ভাই - এর মতাে ।
একে জাতিতে নীচু তায় গরিব । বেশি লেখাপড়া , ভালাে চাকরি বাকরি এসব কি আর আমাদের জন্য ? কিন্তু হাল ছাড়লেন না মেঘনাদ । শুকনাে মুখে , একবুক স্বপ্ন লুকিয়ে রেখে দোকানে বসে চাল ডাল তেল নুন ওজন করেন আর মনে মনে ভাবেন কি করে আবার শুরু করা যায় ।
করলেনও । দাদার হাত ধরে দশ কিলােমিটার দূরের একটি অবৈতনিক স্কুলে ভর্তি হয়ে গেলেন । এখানে মাইনে দিতে হবে না তবে প্রতিদিন দশ দশ কুড়ি মাইল হেঁটে স্কুলে যাওয়া আসা করতে হবে । কিন্তু এ কষ্ট তাে কিছুই নয় । মেঘনাদ মহানন্দে আবার স্কুলে যাওয়া শুরু করলেন । কিন্তু স্কুল যেতে আসতেই এতাে সময় চলে গেলে আর পড়বেন কখন । একদিন সে সমস্যারও এক আশ্চর্য সমাধান করে ফেললেন মেঘনাদের দাদা । স্কুলের কাছেই থাকেন একজন ডাক্তারবাবু । দরিদ্র মেধাবী ছেলেটির খাওয়া পরা আর স্কুলের সব খরচ দিতে হাসিমুখে রাজি হয়ে গেলেন তিনি ।
হতাশ জীবনে আবার ফিরে এলাে আশার আনন্দ । বইপত্র নিয়ে মেঘনাদ এসে আশ্রয় নিলেন ডাক্তারবাবুর বাড়ি । সকালবেলা উঠে বাড়ির সবার এঁটো বাসনপত্র ধুয়ে দেন । ঘরদোর পরিষ্কার করেন । গরুর জাব কাটেন । তারপর নিজের পড়াশােনা করে স্কুলে যান । পরের আশ্রয়ে থেকে চাকরবাকরের কাজ করেও তিনি লেখাপড়া চালিয়ে গেলেন । এমনি দৃঢ়তা ছিল তার মনে ।
কোনাে কাজই ছােটো নয় । দেখতে হবে ছােটো কাজ করার ফলে । বড় কোনাে উদ্দেশ্য সফল হচ্ছে কিনা । তাছাড়া যে কোনাে কাজ করার সময় যদি কাজ করছি না ভেবে সেবা করছি বলে ভাবা যায় তবে কাজটি বড়াে আনন্দের হয়ে ওঠে । কথায় বলে কমই ধর্ম ।
মেঘনাদ সাহার জীবনেও কমই ছিল ধর্ম । সাধনার মতাে করেই পড়াশােনা করলেন তিনি । ফলে স্কলারশিপ নিয়ে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন । পড়তে এলেন কোলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে । কিন্তু এবার পড়ার খরচের কি হবে ! চিন্তায় আকাশ ভেঙে পড়ল মাথায় । হাজার টেনে কষে ও প্রায় ১৫/২০ টাকা মাসে খরচ । এবারও এগিয়ে এলেন সেই দাদা । তিনি মাসে পেতেন ২০ টি টাকা মাইনে তাই থেকে ভাইকে পাঠাতেন ৫ টি করে টাকা । স্কলারশিপের ৪ টাকা আর বৈশ্যসমিতির অনুদান ২ টাকা । এইভাবে যােগাড় হল ১১ টাকা । বাকিটা নিজের অবসরে ছেলে পড়িয়ে যােগাড় করে নিলেন । আবার শুরু হয়ে গেল সংগ্রাম ।
শুধু কি দারিদ্র্য ? জাতপাতের বাধা ? বামুন কায়েতের ছেলেরা সুযােগ পেলেই অপমান করে , টিটকিরি দেয় । ছােটো জাত বলে কলেজের সরস্বতী পুজোয় অঞ্জলি দিতে দেয়া হয় না । সেদিনের শিক্ষিত সমাজও এতােটাই জাতপাত নিয়ে মাথা ঘামাতাে যে সারাজীবন এই মহান বিজ্ঞানীকে অনেক অবজ্ঞা , অনেক অন্যায় আর অবহেলা সহ্য করতে হয়েছে মুখ বুজে । তবু নিজের কাজ থেকে একচুল সরে আসেননি তিনি । অলৌকিক মেধার সঙ্গে অসাধারণ পরিশ্রম জুড়ে দিয়ে তিনি বিশ্বের বিজ্ঞান সাধনাকে এগিয়ে নিয়ে গেলেন অনেক দূর । জ্যোতিঃপদার্থবিদ্যা বা এ্যাস্ট্রোফিজিক্স নিয়ে গবেষণা করে তিনি যেসব থিওরি আবিষ্কার করলেন পরবর্তীকালে সবকটি অগ্রগতিই গড়ে উঠল তার ওপর ভিত্তি করে ।
শুধু কাগজে কলমে গবেষণা নয় বিজ্ঞান সাধনাকে ছড়িয়ে দিতে হবে দিকে দিকে মানবসেবায় । দেশে ভালাে গবেষণাগার নেই , নিজেই ভার নিলেন গড়ে তােলার । ন্যাশনাল এ্যাকাডেমি অব সায়েন্স , ইন্ডিয়ান ফিজিক্যাল সােসাইটি , ন্যাশনাল সায়েন্স এ্যাকাডেমি , ইন্ডিয়ান নিউজ এ্যাসােসিয়েশন— এসব প্রতিষ্ঠান নিজের হাতে গড়ে তুললেন কর্মযােগী মেঘনাদ ।
দেশ যখন স্বাধীন হল , কতাে স্বপ্ন তার , কতাে আশা । বিজ্ঞানকে হাতিয়ার করে দেশের মানুষের দারিদ্র দূর করবেন । দূর করবেন কুসংস্কার আর জাতপাতের বাধা । পরমাণু শক্তির দ্বারা বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা তারই মাথায় এলাে প্রথম । অথচ নেহেরু সরকারের নেতৃত্বে যখন এ্যাটমিক এনার্জি কমিশন তৈরি হল— তখন সর্বাগ্রে বাদ পড়লেন তিনি । মেঘনাদ পেলেন এমন একটি দপ্তর যেখানে তার প্রতিভা ও আগ্রহ কোনাে কাজেই লাগবে না ।
না , এবারেও মেনে নিলেন না মেঘনাদ । আবার হাল ছেড়ে দিয়ে রাজনীতির জটিল আবর্ত থেকে বেরিয়ে এসে শুধু বিজ্ঞানসাধনার মধ্যেই মগ্ন থেকে জীবনের সার্থকতা খুঁজে নিলেন না । তার কারণ তিনি নিজে তাে দেখেছেন এদেশের দরিদ্র , মূর্খ , দলিত মানুষেরা কী অসহনীয় জীবনযাপন করেন । মানুষের জন্য কাজ করতেই হবে— কর্মই ছিল তার একমাত্র ধর্ম ।
ভারতের প্রথম লােকসভা নির্বাচনে নির্দল প্রার্থী হয়ে ভােটে দাঁড়ালেন এবং জিতলেনও বিপুল ভােটে । এবার কোমর বেঁধে নেমে পড়লেন কাজে । তিনি বললেন শুধু ভালাে ভালাে কিছু কথা দিয়ে দেশের উন্নতি হবে না । হতে হলে বিজ্ঞানকে কাজে লাগাতেই হবে । সেকেলে ধ্যানধারণা ছুঁড়ে ফেলে ধরতে হবে বিজ্ঞানের হাত ।
কিন্তু কথায় বলে না গেঁয়ােযােগী ভিখ পায় না । এতাে বড়াে একজন জ্ঞানতপস্বী ও কর্মযােগীকে দেশ চেনেনি । যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে এগিয়ে আসে নি তাঁর স্বপ্ন রূপায়ণে । কিন্তু তবুও অভিমানে কিংবা হতাশায় হাল ছাড়েন নি তিনি । নিজের সাধনার পথে একনিষ্ঠ ভাবে এগিয়ে গিয়েছেন । তাই বিশ্বের বিজ্ঞানীমহলে মেঘনাদ সাহা নামের এই ব্রাত্য বাঙালি বিজ্ঞানীর নাম জ্বলজ্বল করছে সােনার অক্ষরে ।
0 Comments: