ভীম রাও আম্বেদকর
আম্বেদকর তাঁর পৈতৃক উপাধি নয় । ওই উপাধিটি তার স্কুলের হেডমাস্টার মশাই - এর । কিন্তু কেন এরকম হল ? একটা মানুষ সারাটা জীবন তার নিজের পিতৃ - পিতামহের উপাধি ব্যবহার করতে কেন পারলেন না ? কেনই বা তিনি সারাজীবন অন্যের উপাধি বয়ে বেড়াতে বাধ্য হলেন ? শােনাচ্ছি সে ইতিহাস । সে বড়ােই করুণ , বড়ােই লজ্জার কাহিনি ।
এক দলিত পরিবারে চরম দারিদ্রের মধ্যে জন্ম ভীমরাও রামজী সকপাল আম্বেদকরের । বাবা রামজী সকপাল আর মা ভীমাবাঈ । বাড়িতে বারাে তেরােটি ভাই বােন , ঘরে দারিদ্রের যন্ত্রণা । বাইরে সমাজের যন্ত্রণা । তারা যে দলিত , অচ্ছুত । তাঁদের স্পর্শ করে ফেললে উচ্চবর্ণের লােকেদের স্নান করতে হতাে । এক পাত্র থেকে খেলে কিংবা পাশাপাশি বসে খাবার খেলে তাে কথাই নেই । জাত যেত উচ্চবর্ণের
লােকেদের । তখুনি তাদের মাথা মুড়িয়ে , গােবর খেয়ে প্রায়শ্চিত্য করতে হত । কেউ আপত্তি করলে তাকে একঘরে করা হত । মানে সবাই তাকে এড়িয়ে চলতাে তার সাথে কথা বলা , দেওয়ানেওয়া বা মেলামেশা করত না । যাকে ইংরাজিতে বলে বয়কট করা ।
এরকম দলিত ঘরের কোনাে ছেলের পক্ষেই স্কুলে গিয়ে পড়াশুনা করার প্রশ্নই ওঠে না । তাদের জন্মই যে মূর্খ হয়ে থাকা আর উচ্চবর্ণের সেবা করার জন্য । কিন্তু আম্বেদকরের ভাগ্যটা ভালাে ছিল । বাবা ইংরেজের সৈন্যবাহিনিতে চাকরি করতেন । সে সময় সরকার সৈনিকদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখার জন্য বিনা বেতনের স্কুল করে দিয়েছিলেন । সেখানেই শিক্ষার শুরু হল তার । কিন্তু বাবা চাকরি থেকে অবসর নিয়ে সাতারায় এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করলেন । ভীমরাওকে ভর্তি করে দেওয়া হল স্থানীয় প্রাথমিক স্কুলে ।। কিন্তু তিনি যে অস্পৃশ্য , তাকে ছুঁলে যে অন্য ছাত্রদের , এমনকি শিক্ষকদেরও জাত যাবে । তাই ছাত্রদের জন্য নির্দিষ্ট বেঞ্চে না বসে , ভীমরাওকে ক্লাসের এক কোণে মেঝেতে বসতে হত । খাতায় কিছু লিখে বা অঙ্ক কষে মাষ্টারমশাইকে দেখাতে এলে তিনি খাতাটি স্পর্শ করতেন না । অন্য ছাত্ররা মাস্টারমশাই - এর টেবিল ঘিরে দাঁড়িয়ে তাদের খাতা দেখাতাে আর ভীমরাও শুকনাে মুখে দাঁড়িয়ে থাকতাে দূরে । মাস্টারমশাইয়ের মুখে শুনে নিজে নিজেই সংশােধন করে নিত নিজের খাতা । ভাবতে পারাে ? অতটুকুনি একটি ছেলে , তাকে পাশের সহপাঠী থেকে শিক্ষক কেউ ভালােবাসে না , ছোঁয় না , কাছে টানে না । সে থাকে দূরে দূরে একা একা । কেন ? কি দোষ তার ? না , সে অস্পৃশ্য মাহারদের ঘরে জন্মেছে ।
কিন্তু ভাগ্যটা ভীমরাও - এর নেহাতই ভালাে ছিল বলতে হবে । সবাই তাে আর সমান হন না । ওই স্কুলেই একজন সহৃদয় শিক্ষক ছিলেন । তিনি প্রতিদিন দেখতেন ছােট্ট ছেলেটির ওপর সমাজের অত্যাচার । স্কুলে এবং স্কুলের বাইরেও এই অত্যাচার চলতাে সমানে । অথচ এজন্য উঁচু জাতের ছেলেদের কোনাে ব্যাপারেই শাস্তি দেওয়া যাবে না কারণ সেটাই সমাজের প্রচলিত নিয়ম । সেই দয়ালু শিক্ষক তখন এক বুদ্ধি বের করলেন । তিনি শান্ত , ভদ্র , বুদ্ধিমান ভীমরাও - এর নামের সঙ্গে নিজের আম্বেদকর পদবীটা জুড়ে দিলেন । এতে নাম শুনেই নাক সিঁটকে ওঠেন যারা তাদের হাত থেকে কিছুটা অন্তত বাঁচানাে যাবে বেচারীকে । সেই থেকে নিচু জাতের শকপাল পদবী ত্যাগ করে ভীমরাও হলেন ভীমরাও আম্বেদকার ।
মেধাবী ছেলে । এলফিনস্টোন কলেজ থেকে ভালাে নম্বর নিয়ে বি এ পরীক্ষায় পাশ করলেন । বরােদার রাজা এই ছেলেটির মেধার পরিচয় পেয়ে তাকে ডেকে চাকরি দিলেন এবং সেইসঙ্গে আরাে পড়ার জন্যে তাকে আমেরিকা পাঠালেন । আমেরিকা ও লন্ডনে অর্থনীতি ও রাজনীতি নিয়ে পড়াশােনার পাঠ শেষ করে ভীমরাও ভারতে ফিরে এলেন এবং বরােদার রাজার রাজনৈতিক উপদেষ্টা হিসাবে কাজে যোেগ দিলেন । কিন্তু দয়ালু রাজা তখন বুঝতে পারেন নি কি ভুল তিনি করে বসেছেন । এত বড়াে উচুপদে যাকে তিনি বসিয়েছেন সে যে একজন মাহার , ছােটো জাত । তাই ভীমরাও - এর অধীনে থেকে তাঁর হুকুমমতাে কাজ করতে কোনাে কর্মচারীই রাজি হল না ।
ভীমরাও বুঝলেন কুসংস্কারাচ্ছন্ন এই সমাজের ভিতেই ধরেছে পচন । তাকে সারিয়ে তােলা আগে দরকার । তিনি শুরু করলেন আন্দোলন বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে । গান্ধীজি অস্পৃশ্যদের নাম দিয়েছিলেন হরিজন । আম্বেদকর এই নামের তীব্র বিরােধিতা করেন । তিনি বলেন অস্পৃশ্যরা যদি হরিজন বা দেবতার লােক হয় , অন্যরা কি হবে দৈত্যের লােক ? তার মতে এভাবে ‘ হরিজন ’ নাম দিয়ে আলাদা করে দেখান অস্পৃশ্যদের পক্ষে অপমানকর । কিন্তু ভারত সরকার তার যুক্তিতে কর্ণপাত করল না । হরিজন নামটিই চালু থাকলাে ।
আম্বেদকর দেখলেন তার বা তার শ্রেণির কোনাে কথার কোনাে গুরুত্বই সরকার দেয় না উচ্চবর্গের মানুষের সরকার । এরপর ভারত স্বাধীন হতে ( ১৯৪৭ সাল ) প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু সংবিধান রচনার জন্য তাঁকে আহ্বান জানালেন । সংবিধান রচনাকারী পণ্ডিতদলের তিনি হলেন চেয়ারম্যান । প্রায় দুবছর ধরে লেখা হল ভারতীয় সংবিধান । চালু করা হল ২৬ নভেম্বর ১৯৪৯ থেকে ।
আম্বেদকর স্বাধীন দেশের আইনমন্ত্রী হিসেবে হিন্দু আইনের ও বেশ কিছু সংশােধন আনলেন । কিন্তু অন্যেরা তার কথা মানতেই চাইল না । তাঁর আনা হিন্দু আইনের বিল পাশ না করে আটকে দেওয়া হল । প্রচণ্ড অপমানিত হয়ে ড : আম্বেদকর পরিত্যাগ করলেন আইনমন্ত্রীর পদ ।
এতভাবে লাঞ্ছিত ও উপেক্ষিত হতে হতে তিনি বুঝতে পারলেন দেশ স্বাধীন হােক আর পরাধীনই থাকুক তার মতাে অস্পৃশ্য দলিতদের অবস্থা যে তিমিরে সেই তিমিরেই । কিন্তু হতাশায় হাল ছেড়ে দিয়ে চুপ করে বসে রইলেন না । তিনি প্রতিবাদের ভাষা খুঁজতে লাগলেন । শেষে ১৯৫৬ সালের ১৪ অক্টোবর অনুগামীদের নিয়ে ভীমরাও আম্বেদকর হিন্দুধর্ম ত্যাগ করে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করলেন ।
সারা জীবনের সঞ্চিত ক্ষোভ আর গ্লানি এতদিনে তাঁর দূর হল । বৌদ্ধধর্মের ক্ষমা আর প্রেমের মন্ত্রে জুড়িয়ে গেল দীর্ঘ অপমানের দগদগে ক্ষতস্থান । পরম শান্তি নেমে এলাে তার জীবনে ।
১৯৫৬ সাল ৬ ডিসেম্বর গভীর রাত্রে ঘুমের মধ্যে অমৃতলােকে যাত্রা করলেন তিনি । দীর্ঘ অসম যুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত , ঈশ্বরের এই দলিত সন্তানের মুখে তখন পরম প্রশান্তির ছায়া ।
Age , caste , position , opinion - none of these is a bar an entering the chambers of the self .
0 Comments: