লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি এর সফলতার কাহিনী | Best Powerful Motivational Success Story In Bengali | Leonardo Da Vinchi

 লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি

      দ্যা ভিঞ্চি কি কি পারতেন তা না বলে তিনি কি পারতেন না তা বললে বােধহয় তার পরিচয় দেওয়াটা অনেক সহজ হয় । কি না ছিলেন তিনি ? 

     একদিকে অসাধারণ চিত্রশিল্পী , অসাধারণ স্থপতি । অন্যদিকে তিনিই আবার সিভিল এবং মেকানিক্যাল ইঞ্জিনীয়ার । অনন্য পদার্থবিদ আবার যে কোনাে অঙ্ক মুহূর্তের মধ্যে কষে ফেলার মতাে অনন্যসাধারণ গাণিতিক যুদ্ধের অস্ত্রশস্ত্র বানানাের কৌশলে পৃথিবীতে তিনি অদ্বিতীয় আবার তারই চোখে প্রথম ধরা পড়েছে জীববিজ্ঞানের গৃঢ়তম বহু রহস্য । তার তৈরি মূর্তিগুলির দিকে তাকিয়ে মানুষ ধন্দে পড়ে যায়— মূর্তিগুলাে মূর্তিমাত্র না জীবন্ত মানুষ সহজে বুঝতে পারে না । 

       এমন আশ্চর্য প্রতিভাধর অলৌকিক মেধাসম্পন্ন মানুষটি কিন্তু জীবনে কোথাও কখনাে তার যােগ্য মর্যাদা পাননি । শুধুমাত্র একটু সসম্মানে বেচে থাকা আর নিজের সৃষ্টিতে ডুবে থাকার মতাে এক টুকরাে নিরিবিলি নিরাপদ জায়গার সন্ধানে সারাটা জীবন তিনি এক শহর থেকে আর এক শহরে ছুটে বেড়িয়েছেন তাড়া খাওয়া জন্তুর মতাে । কিন্তু ইটালির ক্ষমতাসীন রাজা মহারাজারা কোনাে সহানুভূতি দেখাননি তার প্রতি বরং তাকে প্রাণপণে খাটিয়ে নিয়েছেন নিজেদের স্বার্থে । 

       তবু হাল ছাড়েন নি , ভেঙে পড়েননি ইটালির এই মহামানব । জীবনের লাগাতার দুর্যোগের মাঝখানে বসেও নিরন্তর সৃষ্টি করে গেছেন তিনি । তার আঁকা মােনালিসা , দ্য লাস্ট সাপার আজও বিশ্বের শিল্পরসিকদের বিস্ময়ে নির্বাক করে রাখে ।

        লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি ইটালি দেশের ফ্লরেন্সে ভিঞ্চি নামক এক ছেটো শহরে ১৪৫২ খ্রিস্টাব্দের ১৫ এপ্রিল জন্ম নেন । বড়াে হবার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর বহুমুখী প্রতিভার খ্যাতি ইটালির কোণে কোণে ছড়িয়ে পড়তে থাকে । ফ্লোরেন্সের রাজা তখন মেদিচিরা । তিনি শিল্পসংস্কৃতির সমঝদার ও পৃষ্ঠপােষক । তিনি লিওনার্দোর কথা শুনে তাঁকে ডেকে পাঠালেন । সহজেই রাজসভায় ঠাই হয়ে গেল তার । রাজা মেদিচিরা দ্যা ভিঞ্চির জন্য আরামবিলাসের অঢেল ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন । সেইসঙ্গে ছিল সৃষ্টিতে মগ্ন থাকবার মতাে প্রচুর অবকাশ । দ্যা ভিঞ্চি ভাবলেন জীবনের তরীটা তবে স্বচ্ছন্দেই ভেসে যাবে বুঝি । কিন্তু বাস্তবে তা হলাে না । 

       রাজার নিয়ম ছিল এই যে তার সভায় লিওনার্দোকে নিয়মিত উপস্থিত থাকতে হবে । থাকতেনও । শিল্প ছাড়াও রাজসভায় বিজ্ঞান , দর্শন , অর্থনীতি ইত্যাদি নানা প্রসঙ্গ উঠত । দ্যা ভিঞ্চি সব বিষয়েই জানাতেন তার একান্ত অভিনব চাঁছাছােলা মতামত । 

      কিন্তু এসব মত অভিজ্ঞদের সঙ্গে মিলত না । মিললেও তারা সব ব্যাপারেই তার মাথা গলানােটা পছন্দ করতেন না । তারা বলতেন লিওনার্দো তার নিজস্ব চিত্রশিল্প নিয়েই থাকুন না , আমাদের ব্যাপারে কথা বলব আমরাই । এতােদিন যাঁরা বিজ্ঞানে , দর্শনে , চিকিৎসা , শাস্ত্রে মহাপণ্ডিত বলে গণ্য হতেন— লিওনার্দো সভার মাঝখানেই তাদের ভুল চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতেন ।

      রাজসভায় অনেক শত্রু তৈরি হয়ে গেল তার । তারা রাজার কাছে ক্রমাগত তার নামে নালিশ আনতে লাগলেন । বিরক্ত হয়ে রাজা একদিন সভায় ডেকে পাঠালেন তাঁকে । বললেন- আপনার খ্যাতি চিত্রকর হিসাবেই । অন্য কোনাে বিষয়ে কোনাে মন্তব্য করতে যাবেন আপনি । অনেক নামী দামী প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি আপনার কথায় অপমানিত হয়েছেন । তাই আপনার লজ্জিত হওয়া উচিত । নিজের চরকায় তেল দিন । অন্যের ব্যাপারে নাক গলাতে আসবেন না । 

       রাজার কাছে এহেন ধমক খেয়ে খুবই মর্মাহত হয়ে পড়লেন দ্যা ভিঞ্চি । এরপর থেকে নীরবে সভার একটি কোণে চুপ করে বসে থাকতেন । মিথ্যে এবং ভুল কোনাে কথা নিয়ে সবাই হৈ হৈ করত , সব নীরবে সহ্য করতে হত তাকে । সবাই তাঁকে অবজ্ঞা করত , উপেক্ষা করত । তিনি নীরবে হজম করতেন । 

    একটা সময় আর পারলেন না । একদিন এক শীতের রাতে ফ্লোরেন্সের রাজপ্রাসাদ থেকে সপরিবারে পালালেন । চোরের মতাে । লুকিয়ে , অপরাধীর মতাে মাথা নীচু করে । চুপি চুপি পালালেন , কারণ ধরা পড়লেই হয় প্রাণদণ্ড নয় যাবজ্জীবন কারাবাস । তাই ইটালির সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষটিকে নিজের স্বদেশ থেকে চোরের মতাে চুপিচুপি পালাতে হল শুধু অকপটে সত্য কথা বলার অপরাধে । 

      ফ্লোরেন্স থেকে পালিয়ে দ্যা ভিঞ্চি এলেন মিলানে । মিলানের রাজা ফোর্জা ছিলেন ভয়ানক যুদ্ধবাজ । দ্যা ভিঞ্চি তাকে একটি চিঠি লিখে পাঠালেন । লিখলেন যে তিনি একজন বৈজ্ঞানিক ও যন্ত্রবিদ । অসাধারণ সব যুদ্ধের অস্ত্র তিনি তৈরি করেছেন যা ব্যবহার করলে ফোর্জা সমগ্র ইতালিকে পরাজিত করতে পারবেন । তিনি করেছেন বিশেষ ধরনের এক সেতু যা মুড়ে নিয়ে সর্বত্র যাওয়া যায় । আবার দরকার মতাে সেটি খুলে নিয়ে অনায়াসে পেরােনাে যায় দুরন্ত পাহাড়ী নদী । সেতুটি যেমন হালকা , তেমনি তা আগুনে পােড়ে না , অস্ত্রে কাটে না , জলে ডােবে না । আবার দারুণ শক্তও । সহজে ভাঙ্গে না, দোমড়ায় না । 

      আমার তৈরি এক বিশেষ ধরনের কামান থেকে অনবরত ছোঁড়া যায় বড় বড় পাথরের খণ্ড । অথচ কামানটি ছােটো ও হালকা , সহজে পরিবহনযােগ্য । 

     আমি এমন একটা চমৎকার দাহ্য পদার্থ বানিয়েছি যাতে আগুন ছোঁয়ালেই চারিদিক ধোঁয়ার ঢেকে যাবে আর শত্রুপক্ষ অন্ধকারে দিশাহারা হয়ে সহজেই ধরা পড়ে যাবে । 

      আমি একজন অসামান্য স্থপতি । এমন কিছু অপূর্ব নক্সা আমি করেছি যার সাহায্যে আপনার এই মিলান শহরকে বিশ্বের সুন্দরতম শহর করে তােলা যাবে । আমার তৈরি মূর্তিগুলি শহরকে পৃথিবীবাসীর কাছে আকর্ষণীয় করে তুলবে । 

     দয়া করে একবার আমার কথাগুলাের সত্যতা পরীক্ষা করে দেখুন । যদি একটি কথাও ভুল হয় তবে যে কোনাে শাস্তি আমি মাথা পেতে নেব । এই চিঠিতে নিজের ছবি বা ভাস্কর্যের বিষয়ে বিশেষ কিছু বলেন নি দ্যা ভিঞ্চি । তার কারণ তিনি ভালাে করেই জানতেন যে যুদ্ধবাজ রাজার কাছে ওসবের বিন্দুমাত্র দাম নেই । সে যাই হােক , মিলানের রাজা ফোর্জ দ্যা ভিঞ্চিকে সাদরে ঠাই দিলেন সভায় । 

       এরপর , দ্যা ভিঞ্চির তৈরি যুদ্ধাস্ত্রগুলি ব্যবহার করে একের পর এক যুদ্ধজয় করে চললেন রাজা ফোর্জা । একের পর এক দেশ জয় করতে করতে যুদ্ধটা তার ঘাড়ে একেবারে ভূতের মতাে চেপে বসল । যুদ্ধজয়ের নেশায় তিনি একেবারে উন্মাদ হয়ে গেলেন । যাকে তাকে যখন তখন একেবারে নিকেষ করে দেয়াটাই একটা মজার খেলা হয়ে দাঁড়াল তার ।

       দ্যা ভিঞ্চি বুঝলেন এরকম আধপাগলা লড়াইবাজ লােকের আশ্রয়ে থাকাটা মােটেই নিরাপদ নয় । যদি কোনাে যুদ্ধে দৈবাৎ হার হয়ে যায় । সেদিনই তিনি দ্যা ভিঞ্চিকে হয় হত্যা করবেন নয় চরম অপমান করে তাড়িয়ে দেবেন । 

       তাই তলে তলে আবার নতুন আশ্রয়ের খোঁজ করতে লাগলেন তিনি । চিঠি লিখলেন খ্রিস্টান সমাজের মাথা মহামান্য পােপকে। পােপ দ্যা ভিঞ্চির সব কথা জানলেন কিন্তু তার চিঠির কোনাে উত্তর দিলেন না । 

       দ্যা ভিঞ্চি এবার আশ্রয় নিলেন সিজার কের্জিয়ার কাছে । ইনি রাজা মহারাজা না হলেও অর্থ ও ক্ষমতা ছিল প্রচুর । দ্যা ভিঞ্চির । প্রতিভার পরিচয় পেয়ে তিনি তাঁকে সাদরে আশ্রয় দিলেন নিজের অট্টালিকায় । 

      আগের অভিজ্ঞতায় দ্যা ভিঞ্চি সাবধানী হয়ে গিয়েছিলেন । কথাবার্তা বলেন খুব সতর্কভাবে । ভয়ে ভয়ে চুপচাপ থাকেন , ক্ষমতাশালী লােকেদের পারৎপক্ষে ছায়া মাড়ান না । 

       এখানে তার পদ ছিল জনৈক সিভিল ইঞ্জিনীয়ারে সহকারী । এই সামান্য তুচ্ছ একটি পদে কাজের সুযােগ , সৃষ্টির সুযােগ বা প্রতিভা ব্যবহারের সুযােগ একবিন্দু নেই । নেই উদ্ভাবনের কোনাে প্রয়ােজনও । তবু হাল ছাড়লেন না দ্যা ভিঞ্চি । নিজের দুর্ভাগ্যকে শান্তভাবেই মেনে নিলেন তিনি । নিঃশব্দে কাটিয়ে দিলেন একে একে এগারােটি বছর । জীবনের গ্লানিময় এই এগারােটি বছরের একঘেয়ে জীবনের দুঃখ ও ব্যর্থতা ভুলতে অবসর সময়ে নিজের ঘরের এক কোণায় বসে ছবি আঁকতেন দ্যা ভিঞ্চি । একের পর এক আঁকা হয়ে গেল মােনালিসা , দ্যা ক্রিয়েশন অব ম্যান , সিস্টিন চ্যাপেল , লাস্টসাপার প্রভৃতির মতাে দুর্ধর্ষ অতুলনীয় সব ছবি বিশ্বের বাজারে যার দাম কোটি কোটি টাকা । 

       এগারােটি বছর নিঃসঙ্গ জীবন কাটাবার পর আরও একবার পােপের কাছে আশ্রয় ভিক্ষা করে আবেদন করলেন দ্যা ভিঞ্চি । এবার পােপের মন গলল । আশ্রয় পেলেন দ্যা ভিঞ্চি কিন্তু মর্যাদা পেলেন না । পােপ তাঁকে ঢুকিয়ে দিলেন অদ্ভুত একটি কাজে । তাঁর নিজস্ব । টাকশালাটির দেখভাল করার কাজ । 

       স্বপ্নভঙ্গের নিদারুণ হতাশায় হাহাকার করে উঠল এই মহাপ্রতিভাধর শিল্পীর হৃদয় । কিন্তু কিই বা করার আছে তার অদৃষ্টকে মেনে নেওয়া ছাড়া ? কেটে গেল আরাে চার বছর । দীর্ঘদিনের । চাপা দুঃখ আর হতাশা ততােদিনে কামড় বসিয়েছে তার স্বাস্থ্যে । দিন দিন ক্ষীণ হতে লাগল দৃষ্টিশক্তি । 

      তবু দ্যা ভিঞ্চি হাল ছাড়লেন না । প্রৌঢ় বয়সেও তিনি স্বপ্ন দেখতে লাগলেন পৃথিবীর কোনাে না কোনাে প্রান্তে কেউ না কেউ একদিন ঠিক বুঝতে পারবে তার দাম আর সেদিন তিনি কড়ায় গণ্ডায় উশুল । করে নেবেন জীবনের যতাে বকেয়া পাওনা । 

       এই স্বপ্ন বুকে নিয়েই আবার এক দিন ইটালি ছেড়ে ফ্রান্সের পথে পা বাড়ালেন তিনি । জাত শিল্পী , ফরাসিরা লুফে নিল তাঁকে । শত শত কণ্ঠে উঠল প্রশংসা আর স্তুতি । আবার নতুন করে মেতে উঠলেন শিল্পী সৃষ্টির আনন্দে । জীবনের শেষ দুটি বছর নিজেকে উজাড় করে দিলেন তিনি । ইটালির মাটিতে ১৫১৯ খ্রি . শেষ নিঃশ্বাস ফেলার আগে তিনি যেন সদর্পে ঘােষণা করে গেলেন— যা শ্রেষ্ঠ তার জয় হবেই হবে । হাল ধরে যে বসে থাকে তার তরী একদিন সাফল্যের কূলে ঠিকই পৌছে যায় । 

        God sees the truth but waits .

0 Comments: