কালিদাসের সফলতার কাহিনী | Kalidash bangla success story | Bangla motivational success story |

কালিদাসের সফলতার কাহিনী | Kalidash bangla success story | Bangla motivational success story |

 কালিদাস

       মহাকবি কালিদাসের নাম শুধু তোমরা কেন পৃথিবীর যে কোনাে শিক্ষিত ব্যক্তিই শুনেছেন । অনেকেই পড়েছেন তাঁর কাব্য । বিশ্বের পণ্ডিত ব্যক্তিরা একবাক্যে স্বীকার করেছেন কালিদাসের লেখা অভিজ্ঞান শকুন্তলম , মেঘদূত , কুমারসম্ভব প্রভৃতি কাব্য- অপূর্ব , বিশ্বের সেরা সাহিত্যের অন্যতম । 

      এহেন মহাপণ্ডিত মহাকবি কালিদাস যে প্রথম জীবনে একজন আকাট মূর্খ লােক ছিলেন তা বােধহয় অনেকেই জান না ।

      কালিদাসের জীবনের সেই উত্তরণের গল্প যেমন আশ্চর্য তেমনি শিক্ষণীয় । 

       বর্তমানে মধ্যপ্রদেশ রাজ্যের উজ্জয়িনী ছিল গুপ্তরাজ চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্যের রাজধানী । ঐতিহাসিকরা গুপ্ত যুগকে বলেন ভারতের সুবর্ণ যুগ , শিল্পে , সাহিত্যে , দর্শনে , বিজ্ঞানে , বাণিজ্যে সব বিষয়েই চরম সাফল্য এসেছিল এই যুগে । পুরুষরা তাে বটেই পরিবারের মেয়েরাও লাভ করতেন উচ্চশিক্ষা । তাদের সবাই খুব সম্মানও করত । 

        উজ্জয়িনী রাজ্যেরই কোনাে এক রাজকন্যা ছিলেন রত্নাবলী । তিনি যেমন সুন্দরী তেমনি বিদূষী । দেশবিদেশের রাজপুত্ররা আসত তাঁকে বিয়ে করতে , কিন্তু রাজকন্যা তাদের তর্কযুদ্ধে হারিয়ে একেবারে নাস্তানাবুদ করে ছেড়ে দিতেন । দিনের পর দিন বড়াে বড়াে রাজা , রাজপুত্রেরা বিদূষী রাজকন্যার বিদ্যাবুদ্ধির কাছে গােহারা হারতে হারতে একসময় জোট বাঁধলেন । সবাই মিলে ঠিক করলেন রাজকন্যার বিদ্যার অহংকার ভাঙতেই হবে । প্রতিশােধ নেওয়ার জন্য তারা গভীর ষড়যন্ত্র করে এক আকাট মূর্খ দরিদ্র ব্যক্তির সঙ্গে রাজকন্যার বিয়ে দিয়ে দিলেন । ওই ব্যক্তি আর কেউ নন স্বয়ং কালিদাস । 

        যাই হােক , বিয়ে তাে হয়ে গেল । কিন্তু বাসর রাত্রেই স্বামীর সঙ্গে আলাপ করতে গিয়ে রাজকন্যা বুঝতে পারলেন একজন গণ্ড মুখের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে তাঁর । বুঝতে পারলেন অপমানিত প্রত্যাখাত রাজপুত্রেরা এভাবেই প্রতিশােধ নিয়েছে । কিন্তু তাই বলে একজন গণ্ড মূর্খকে স্বামী বলে সারাজীবন মেনে নিতে হবে— এ ব্যবস্থাও তিনি মেনে নিতে পারলেন না । অপমান করে সেই রাত্রেই স্বামীকে রাজপ্রাসাদ থেকে তাড়িয়ে দিলেন রত্নাবলী । 

      মূর্খ হলেও স্ত্রীর এই অপমানে মর্মান্তিক দুঃখ পেলেন কালিদাস । তিনি ভাবলেন এই লাঞ্ছিত জীবন তিনি আর রাখবেন না । বেশ তাে ছিলেন তিনি । মূর্খ হােন , দরিদ্র হােন নিজের মতােই ছিলেন । রাজপুত্ররাই তাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে কৌশলে রাজকন্যার সঙ্গে বিয়ে দিয়েছেন । এবার বন্ধুবান্ধব , আত্মীয়স্বজন কারাে কাছে কি তিনি আর মুখ দেখাতে পারবেন ? সবাই বিদ্রুপ করবে , করুণা করবে , মজা দেখবে ; নাঃ এ ঘৃণিত জীবন আজ রাতেই ওই নদীর জলে ডুবে ত্যাগ করবেন তিনি ।

       মাথা নীচু করে একমনে উজ্জয়িনীর রাজপথ ধরে হেঁটে চলেছেন কালিদাস । বুকের মধ্যে দাউ দাউ করে জ্বলছে অপমানের তীব্র জ্বালা । চলতে চলতে একসময় শিপ্রা নদীর তীরে এসে দাঁড়ালেন তিনি । সামনে , একটু নীচেই পাহাড়ের কোল বেয়ে বয়ে চলেছে শিপ্রা । স্নিগ্ধ , শীতল , গভীর কালাে জল তার । কালিদাসের মনে হল যেন সেই জল মায়ের মতাে পরম মমতায় হাতছানি দিয়ে তাকে ডাকছে । যেন তার স্নিগ্ধ শীতল স্পর্শেই সব জ্বালা , সব লজ্জা জুড়িয়ে যাবে তার এখনি । পাথরে পাথরে পা রেখে , পায়ে পায়ে নীচে নেমে এলেন কালিদাস । পায়ের কাছে জল । জলের একেবারে কোল ঘেঁসে পড়ে থাকা একটা বড়াে পাথরের খণ্ডের ওপর একটু বসলেন কবি । জলের স্পর্শে আর নদীর ঠাণ্ডা বাতাসে মনের ভার একটু হাল্কা হয়ে এল তার । মনে পড়ল— বাপ মায়ের কথা । মনে পড়ল শৈশবের সাথীদের কথা । দুচোখ জ্বালা করে উঠল তাঁর । ঝর ঝর করে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল দুগাল বেয়ে । পরনের কাপড় দিয়ে দুচোখ মুছে চুপ করে বসে বসে ভাবতে লাগলেন । তিনি ছােটবেলাকার নানা কথা । 

        চারিদিকে ইতস্তত ছড়ানাে আছে ছোটো বড়াে নানা আকারের পাথর । এদের মধ্যে একটা বেশ বড়াে পাথরের দিকে চোখ পড়তে বেশ অবাক হয়ে গেলেন কালিদাস । পাথরটা অন্য পাথরগুলাের তুলনায় বেশ মসৃণ , চওড়া আর ঝকঝকে পরিষ্কার । কালিদাস আপন মনে বসে বসে ভাবতে লাগলেন কেন এমনটা হল । অন্য পাথরগুলাে এমন এবড়াে খেবড়াে অথচ এই পাথরটা হঠাৎ এতাে মসৃণ হলাে কেমন করে ?

      হঠাৎ বিদ্যুত চমকের মতাে তার মনে পড়ে গেল একদিনের কথা । আনমনে নদীর তীরে বেড়াতে বেড়াতে সেদিন তিনি দেখেছিলেন পল্লীর মেয়েরা দলবেঁধে নদী থেকে জল নিতে এসেছে । সেদিন তারা যখন বসে বসে গল্প করছিল কিংবা নদীতে স্নান করতে করতে সাঁতার কাটছিল , তখন তাদের জলভরা পিতলের কলসীগুলাে তাে ওখানেই ওই বড়াে পাথরটার ওপরেই রাখা ছিলাে । দিনের পর দিন এভাবেই রাখতে রাখতে ঐখানে পাথর ক্ষয়ে গিয়ে ওরকম মসৃণ আর পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে । অন্য পাথরগুলাের মতাে তার ওপর কোথাও একটি ফোটাও শেওলা জমে নেই ।

      কালিদাস ভাবতে লাগলেন বসে বসে । দিনের পর দিন , বছরের পর বছর কলসী রাখতে রাখতে একসময় রুক্ষ পাথর ও ক্ষয়ে গিয়ে মসৃণ হয়ে গেল । তাহলে মানুষের মগজ কি পাথরের চেয়েও কঠিন ? দিনের পর দিন চেষ্টা চালিয়ে গেলে তিনিও কি মূর্খ কালিদাস থেকে পণ্ডিত কালিদাস হয়ে উঠতে পারবেন না ? 

       সেদিন শেষরাত্রে বাড়ি ফিরলেন তিনি । দরিদ্র পল্লী , পাতার কুটির । নিঃশব্দে নিজের ঘরে প্রবেশ করে দ্বার বন্ধ করে দিলেন তিনি । শুরু হয়ে গেল নীরব সাধনা । সবার অগােচরে । একে একে সমস্ত শাস্ত্র পাঠ করে সবার অলক্ষ্যেই মহাপণ্ডিত হয়ে উঠলেন তিনি । মুখে মুখে রচনা করতে লাগলেন অপূর্ব সুন্দর সব শ্লোক । ভূর্জ পত্রের ওপর শরের কলম দিয়ে একে একে রচনা করতে লাগলেন ঋতুসংহার , কুমারসম্ভব , বিক্রমাের্বশী , মেঘদূত , শকুন্তলা ।

       প্রতিভা কখনাে চাপা থাকে না । একদিন সম্রাট বিক্রমাদিত্যের কানে ঠিক পৌছে গেলাে তার কথা । সাদরে মহাকবিকে ডেকে নিজের সভায় বরণ করে নিলেন তিনি । কালিদাস হলেন- সম্রাটের নবরত্ন সভার সর্বশ্রেষ্ঠ রত্ন । 

      আর রত্নাবলী ? ততােদিনে ভুল ভেঙেছে তার । ভেঙেছে বিদ্যার অহংকারও । মহাপণ্ডিত মহাকবি কালিদাসকে স্বামীত্বে বরণ করে নিয়ে ভাগ্যবতী রাজকন্যা নিজেকে ধন্য মনে করলেন । 

     ‘ নহি সুপ্তস্য সিংহস্য প্রবিশান্তি মুখে মৃগাঃ '

        —ঘুমন্ত সিংহের মুখে হরিণ নিজে এসে প্রবেশ করে না ।

                                                সমাপ্ত 

সৌরভ গাঙ্গুলী এর সফলতার কাহিনী | Sourav Ganguly Success Story In Bengali | Bangla Motivational Success Story

সৌরভ গাঙ্গুলী এর সফলতার কাহিনী | Sourav Ganguly Success Story  In Bengali | Bangla Motivational Success Story

 Bangla success story :- This success story written by jayanti Chakraborty. This story revolves around Sourav Ganguly like Sourav Ganguly biography. Sourav Ganguly life story in bengali. We are collected this type success story that revive your lost mind. You get more success story on Bengali in our website. And I think all success story will take place in your mind. So please share this story to your friends and I sure they will also benefit from this success story. Thank you so much. 

সৌরভ গাঙ্গুলী

      নামটি পড়েই নিশ্চই তােমরা ‘ দাদা ’ ‘ দাদা ’ বলে লাফিয়ে উঠেছ । ঠিকই তো , সারা পৃথিবীতে ব্যাটসম্যান অনেক আছেন , ক্যাপ্টেনও অনেক । তাদের রান আর সেঞ্চুরির সংখ্যাও চমকে যাবার মতাে , কিন্তু ‘ দাদা একজনই । 

      সৌরভ সারা ভারতকে এক গভীর , পবিত্র আবেগের একসূত্রে বাঁধতে পেরেছিলেন । সে আবেগের নাম দেশাত্মবােধ । 

      সৌরভ দেখিয়ে দিয়েছেন আমরাও পারি । শুধু পিঠ বাঁচাতে আর মার খেতে নয় , আমরাও তাে পারি অস্ট্রেলিয়া , দক্ষিণ আফ্রিকা , পাকিস্তানের মতাে দলগুলােকে পিটিয়ে ছাতু করে দিতে । আমরা কিস্যু নয়— আমাদের কিছুই হবে না এই মনমরা হাল ছাড়া ভাবটা যুব সমাজের বুক থেকে ভুস্ করে উধাও হয়ে যেত ব্যাট হাতে মহারাজ যখনই দাঁড়াতেন এসে বাইশ গজের রাজ্যপাটের মাঝখানে । তার সঙ্গে খেলত সারা ভারত । জয় , পরাজয়ে , আনন্দে , বিষাদে এক হয়ে যেত । ভারতীয় ক্রিকেটকে তিনি এক অতি উচ্চ মর্যাদাপূর্ণ আসনে বসিয়ে দিতে পেরেছেন । বিশ্ববাসীর কাছে পেয়েছেন অকুণ্ঠ প্রশংসা ভালােবাসা আর সম্মান । তিনিই ভারতের সর্বকালের সবচেয়ে সফল শ্রেষ্ঠ অধিনায়ক । কিন্তু কত যে যন্ত্রণা , কত সূক্ষ্ম অপমান , কত নিমর্ম উপেক্ষা আর অবহেলার দুঃখ যে তাকে নীরবে সহ্য করতে হয়েছে , নিজেকে বার বার প্রমাণ করতে হয়েছে নীতিভ্রষ্ট , অযােগ্য , একপেশে বিচারকদের সভায়— সে ইতিহাস জানলে তার প্রতি আরাে বেশি শ্রদ্ধায় , আরাে বেশি ভালােবাসায় ভরে যাবে তােমাদের অন্তর ।

       বেহালার বীরেন রায় রােডের এক আপাদমস্তক ক্রীড়ানুরাগী এবং ধনী পরিবারে সৌরভের জন্ম । ডাক নাম মহারাজ । ছেলেবেলায় ভালাে ফুটবল খেলতেন । দাদা স্নেহাশীষ ও ভালাে খেলােয়াড় । বাড়ির মধ্যেই অনুশীলনের জন্যে বাবা চণ্ডী গাঙ্গুলী সব রকম ব্যবস্থা করে দিয়েছেন । 

      হঠাৎ করেই কোচ দেবু মিত্রের চোখে পড়ে গেলেন । ছেলেটির মধ্যে বিপুল সম্ভাবনার অংকুর দেখতে পেয়ে নিজেই উপযাচক হয়ে এগিয়ে এলেন দেবু মিত্র । শুরু হয়ে গেল প্রশিক্ষণ-- ব্যাটে বলে । বয়স বাড়বার সঙ্গে সঙ্গে খেলাতেও ফুটতে লাগল জৌলুস । বাঁ হাতে খেলেন , দ্রুত খেলেন । হাতে দিব্যি রান আছে । কিছু ব্যাটসম্যান আছেন যারা রান তােলার চেয়ে ক্রীজে টিকে থাকাটাই বেশি পছন্দ করেন । সৌরভ তাদের দলে নন । তিনি খেলেন পিটিয়ে । চুটিয়ে । ঘন ঘন ছক্কা আর চারের উল্লাসে ফেটে পড়ে দর্শকের গ্যালারি । একইসঙ্গে বলও করেন দুর্ধর্ষ । স্বাভাবিক ভাবেই ভারতের ক্রিকেট অভিভাবক মহলের চোখ পড়ল তার দিকে । ক্রিকেট বাের্ডের প্রেসিডেন্ট তখন জগমােহন ডালমিয়া । ভারি ভালাে লেগে গেল তার ছেলেটিকে । প্রধানত তারই সুপারিশে এবং অবশ্যই আঞ্চলিক ম্যাচগুলিতে পারফরম্যানসের রেকর্ডের জোরে জাতীয় ক্রিকেট দলে সুযােগ পেয়ে গেলেন সৌরভ । তখন তার বয়স মাত্র আঠারাে বছর । সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে বি কম পড়ছেন । ১৯৯২ সাল সেটা ।অস্ট্রেলিয়া সফরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে একটিমাত্র ম্যাচে খেলার সুযােগ পেলেন তিনি । ভাগ্য প্রতিকূল । মাত্র ৩ রানেই আউট হয়ে গেলেন ।

        বাদ পড়াটা স্বাভাবিক । পড়লেনও । কিন্তু অনেক মিথ্যা অপবাদও জুড়ে গেল তার নামের সঙ্গে । তিনি অহংকারী । দলের সঙ্গে মিশতে চান না , অলস , মাঠের মধ্যে জল বয়ে নিয়ে যেতে অস্বীকার করেছেন । ইত্যাদি ইত্যাদি । 

       সহযােগী ক্রিকেটাররা ব্যঙ্গ করে বললেন- বড়ােলােকের ছেলে । তাে , স্বয়ং মহারাজ ... কাজেই ...

      আসলে যারা এতটুকু উন্নতির আশায় কর্তাদের তৈলমর্দন করেন দিনরাত , সৌরভ সেই প্রজাতির অমেরুদণ্ডী প্রাণী নন । তিনি হলেন প্রকৃত অর্থেই আর্যসন্তান ; বীর ও ব্যক্তিত্ববান পুরুষ । খেলােয়াড় হিসেবে নিজের খেলাটাকে ছাড়া আর কিছুকেই গুরুত্ব দিতে রাজী নন । 

        চার বছরের জন্য জাতীয় দলে খেলার সুযােগ থেকে বঞ্চিত করা হল তাকে । সৌরভ ভেঙে পড়লেন না । জীবনের প্রথম পদক্ষেপেই এইরকম আঘাত পেয়ে যে রকম উদ্যমহীন হয়ে পড়ার কথা তিনি তা মােটেই হলেন না । বরং প্রতিদিন নিয়মিত কঠোর অনুশীলন করে নিজের দোষত্রুটিগুলাে একে একে দূর করে ফেললেন । 

       জনশূন্য ফাকা ইডেনের মাঠে ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্র্যাকটিশ করতেন । তারপর বাড়িতে এসেই সেই খেলার রেকর্ডিং দেখতে বসে যেতেন । খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে দেখে নিজের ভুল ত্রুটিগুলি সযত্নে খুঁজে খুঁজে বার করতেন আর প্রতিজ্ঞা করতেন পরদিনের প্র্যাকটিসে একই ভুল আর করবেন না ।

       এইভাবে সাধনায় আর সংগ্রামে কেটে গেল নির্বাসনের চারটি বছর । ১৯৯৬ সাল । আবার জাতীয় দলে ফিরে এলেন সৌরভ । নির্বাচিত হলেন ইংল্যান্ড সফরের জন্য । জীবনে এই দ্বিতীয় সুযােগ । কোনােমতেই একে হারালে চলবে না । নিজেকে প্রমাণ করতেই হবে । না হলে পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাবে চিরতরে । 

      কঠিন প্রতিজ্ঞা বুকে নিয়ে দলের সঙ্গে এগিয়ে চলেছেন বিমানে ওঠার সিঁড়ির দিকে । হঠাৎ কানে এসে লাগল তীক্ষ্ণ ছুচের মতাে মন্তব্য ‘ দূর ! দূর ! ডালমিয়ার কোটার ক্রিকেটার । ও আবার কি করবে । ইংল্যান্ডে গিয়ে মার্কেটিং টার্কেটিং করে ফিরে আসবে ।'

      অপমানে দুকান গরম হয়ে গেল যেন আগুনের মতাে জ্বলতে লাগল সারা মুখ , সারা সত্তা । কিন্তু না , হার মানলেন না তিনি । এ আগুনে নিজে না ছাই হয়ে বরং এই আগুনের আঁচেই নিজের প্রতিজ্ঞাকে আরাে বেশি করে তাতিয়ে নিলেন সৌরভ । 

       ইংল্যান্ডের লর্ডসে , জীবনের প্রথম আন্তর্জাতিক মাঠে টেস্ট খেলতে নেমেই সেঞ্চুরি করে ফেললেন । পরের টেস্ট টেন্টব্রিজে । আবার সেঞ্চুরি । অভিষেকেই এই অভূতপূর্ব সাফল্য , জাতীয় ক্রিকেটে তার আসন পাকা করে দিল । এবার তিনি নিশ্চিন্ত মনে খেলে যেতে পারবেন ,এরকম কথা অনেকেই ভাবলেন সেদিন । কিন্তু দুর্নীতি আর প্রাদেশিকতার কালরােগ তখন রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়েছে জাতীয় ক্রিকেট বাের্ডের অন্দরমহলে । সবসময় তারা ছিদ্র খুঁজে যেতে লাগলেন কি করে এই দুর্বার বাঙালির ছেলেটাকে কোণঠাসা করা যায় । 

        কিন্তু সৌরভ যে ক্রমাগতই ছড়িয়ে পড়ছেন কৃতিত্বের দিকদিগন্ত জুড়ে । টরেন্টোয় পরপর চারটে ম্যাচে ম্যান অব দ্য ম্যাচ হলেন । ১৯৯৯ - এর বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে ১৮৩ রান করলেন । এতাে ভালাে পারফরম্যান্স তবু নিন্দা আর সমালােচনা তার পিছন ছাড়েনি কোনােদিন । যতােবড়াে ক্রিকেটারই হােন না কেন প্রতিটি ম্যাচেই তিনি সেঞ্চুরি করতে পারেন না । কারণ খেলােয়াড় মাত্রেই মানুষ— যন্ত্র নয় । অথচ বড়ােমাপের খেলােয়াড়ের কাছে মানুষের প্রত্যাশাও অনেক বেশি । যখনই সেই প্রত্যাশার তুলনায় কম রান করছেন তখনই মুখর হয়ে উঠছে নিন্দুকরা । 

       সৌরভের মাথার ওপরে তার ক্রিকেট জীবনের ১৩ টা বছর সমানে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল একটা উদ্যত খাড়া । কখনাে তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে সাত নম্বরে , কখনাে বলা হয়েছে শুধু ব্যাটসম্যান নয় , এবার ভালাে বােলার হিসেবেও নিজের যােগ্যতা প্রমাণ করতে হবে । কখনাে বলা হল ওপেন করতে পারলেই দলে সুযােগ পাবে । সব পরীক্ষাতেই সসম্মানে উত্তীর্ণ হলেন তিনি । 

       অবশেষে সত্যের কাছে হার মানতেই হল দুষ্টচক্রকে । ২০০০ সালে সৌরভ গাঙ্গুলী হলেন জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক । দল তখন ধুকছে । ম্যাচ গড়াপেটার দুষ্টখেলায় এক নম্বর দল । অন্তর্দ্বন্দ্বে , দলাদলিতে , পারফরম্যান্সে সবদিকেই ভারতীয় দলের তখন চরম অবক্ষয় । এই অবস্থায় সব দায়দায়িত্ব হাসিমুখে মাথায় তুলে নিলেন সৌরভ । 

      অধিনায়কের সবগুলি গুণই তার মধ্যে বর্তমান । সৌরভের নেতৃত্বে , পক্ষপাতিত্ব হীন সহমর্মী মনােভাব দলের মধ্যে এক অভূতপূর্ব টিম স্পিরিট গড়ে তুলল । তিনি একের পর এক নতুন প্রতিভা খুঁজে এনে দলকে সমৃদ্ধ করলেন । যুবরাজ , হরভজন , ধােনী , জাহির খান বর্তমান জাতীয় দলের মাঠ কাঁপানাে খেলােয়াড় যাঁরা— সবই সৌরভের আবিষ্কার । কয়েক বছরের মধ্যে দলের ভেতরকার সব ভূত তাড়িয়ে দলকে চাঙ্গা করে তুললেন তিনি । আসতে লাগল একের পর এক জয় । ২০০২ - এ ইংল্যান্ডে ন্যাটওয়েস্ট ট্রফির ফাইনাল । ইংল্যান্ডকে একেবারে গুড়িয়ে নিলেন সৌরভ । আনন্দে উদ্বেল অধিনায়ক লর্ডসের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে গা থেকে খুলে ফেললেন জার্সি । ওড়াতে লাগলেন হু হু হাওয়ায় । 

       বিশ্বক্রিকেটের ইতিহাসে এই অভিনব দৃশ্য অমর হয়ে রইল । অমর হয়ে রইল ভারতীয়দের মনের মণিকোঠায় । ঠিক আগের বছরই ২০০১ - এ পৃথিবীর সেরা দল অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে প্রথমবার টেস্ট সিরিজ জিতল । অষ্ট্রেলিয়ায় হল ড্র । একটি ম্যাচে সেঞ্চুরি করলেন সৌরভ ।

        কিন্তু অধিনায়কের বিরাট দায়িত্ব , সেইসঙ্গে দর্শকের প্রত্যাশার বিপুল চাপে সৌরভের ব্যক্তিগত খেলার মান সর্বদা ঠিক থাকছিল না । ২০০৫ - এ জিম্বাওয়ে সফরে এসেছে ভারত । সেটা জুন মাস । কোচ গ্রেগ চ্যাপেল বললেন , অধিনায়কত্ব থেকে সরে দাঁড়াতে । 

       কিন্তু কেন ? সৌরভ কিছুতেই বুঝতে পারলেন না তাঁর খামতিটা কোথায় ? চ্যাপেলের কথার উত্তরে তিনি তার হাতে তুলে দিলেন নিটোল একটি সেঞ্চুরি । মান - অভিমান বা বাদানুবাদ নয়— সৌরভ তার সব উত্তর দিয়েছেন ব্যাটের ঘায়ে । কিন্তু তবুও তাকে বাদ পড়তে হল আবার । কনুই - এর চোটের জন্য চ্যালেঞ্জার সিরিজ খেলতে পারলেন না । আরও নানা অজুহাত দেখিয়ে সৌরভের অধিনায়কত্ব ছিনিয়ে নেওয়া হল । দল থেকেও বাদ পড়লেন তিনি । অথচ তার ঝুলিতে তখন ৬০০০ - এর বেশি রান । ১৫ টি সেঞ্চুরি । একমাত্র সুনীল গাভাস্কার ছাড়া আর কোনাে ভারতীয় ক্রিকেটারের কেরিয়ার গড় কখনােই ১০ ছাড়ায়নি । অথচ সৌরভের গড় ৪০ - এর বেশি । 

       তবুও এই বঞ্চনা তাকে সহ্য করতে হল । সহ্য করতে হল এত বড়াে অন্যায় অবিচার । না , তবু সৌরভ ভেঙে পড়লেন না । হাল ছাড়লেন না। অবিশ্বাস্য মনের জোর নিয়ে আবার ফিরে এলেন নিরলস অনুশীলনে । জানতেন জবাব মুখে দিলে তা গুরুত্ব হারায় । জবাব দিতে হবে ব্যাটে । খেলা ছাড়লে চলবে না । তাই বাংলা দলের সঙ্গে একের পর এক ম্যাচ খেলতে গিয়েছেন । কোথায় লক্ষ লক্ষ দর্শকের করতালি মুখরিত স্টেডিয়াম আর কোথাও এই নির্জন , নিষ্প্রাণ ঘরােয়া ক্রিকেট । তবু প্রতিটি অখ্যাত অজ্ঞাত খেলােয়াড়ের সঙ্গে বন্ধুর মতাে মিশেছেন । দুর্বলতম বােলারকেও খেলেছেন একান্ত মনােযােগের সঙ্গে । কাউকে উপেক্ষা বা অবহেলা বা তাচ্ছিল্য করেন নি । কারও বিরুদ্ধে অভিমান বা ক্ষোভ উগরে দেন নি । অভিযােগ আনেন নি কারও নামে । শান্ত , অবিচলিত ভাবে সমস্ত অন্যায় সহ্য করেছেন মুখ বুজে । 

        কী দুঃসময় না গেছে তার তখন । নিতান্ত ঘনিষ্ঠরাও তখন ধরে নিয়েছে সৌরভ গাঙ্গুলি শেষ হয়ে গেছেন । ফুরিয়ে গেছে তার সমস্ত শক্তি ।

       ছােট্ট মেয়ে সানা প্রশ্ন করেছে ,

        -বাবা , তুমি আর খেলাে না কেন ?

      –আমি যে আর খেলতে পারি না মা । নির্লিপ্তভাবে উত্তর দিয়েছেন সৌরভ । 

       কিন্তু পারলেন । আবার দুর্দান্তভাবে ফর্মে ফিরে এলেন সৌরভ গাঙ্গুলী নামের বিস্ময় । দীর্ঘ ১০ মাস পর আবার জাতীয় দলে জায়গা করে নিলেন । প্রথম খেললেন দক্ষিণ আফ্রিকায় । ৫১ রানে নট আউট । ২০০৭ - এ আবার কাপিয়ে দিলেন সারা পৃথিবী । পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ব্যাঙ্গালােরের মাঠে ২৩৯ রান করলেন । কমাস পরেই নভেম্বরে খেলতে নামলেন ইডেনের মাঠে । বাঙালির সংবাদমাধ্যমগুলিই বিরূপ সমালােচনায় , সবচেয়ে বেশি বিরােধিতা করেছে তার সঙ্গে । এদের একটা উচিত জবাব দিতেই হবে । 

       ইডেনে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মাঠে নেমেই নিটোল তাজা একটি সেঞ্চুরি ছুঁড়ে দিলেন । চুপ করিয়ে দিলেন তাদের , যারা এতদিন ধরেই নিয়েছিল সৌরভ গাঙ্গুলি ইতিহাস হয়ে গেছেন । সৌরভের এই দুর্দান্ত কামব্যাকে সবচেয়ে কষ্ট পেলেন তারই দলের কোচ গ্রেগ চ্যাপেল । এই অস্ট্রেলিয় ভদ্রলােককে সৌরভই এনেছিলেন দলের প্রশিক্ষক করে । কিন্তু চিরবিজয়ী অস্ট্রেলিয়ার মুকুট ধুলােয় লুটিয়ে দেয় যে দুর্দম , অহংকারী ভারতীয় ছেলেটা , তাকে ছলে বলে কৌশলে ধ্বংস করতে না পারলে যে অস্ট্রেলিয় ভদ্রলােকটির শান্তি নেই । তাই , গােপনে চলতে লাগল গভীর ষড়যন্ত্র । ২০০৮ - এ অস্ট্রেলিয়া সফরে টেস্টে যথেষ্ট ভালাে করা সত্ত্বেও একদিনের সিরিজে টিম থেকে বাদ পড়লেন সৌরভ । কিন্তু কেন ? তার রেকর্ড তাে কারাে চেয়ে খারাপ নয় । একদিনের ম্যাচে ভারতের অন্যতম সেরা জুটি হলেন শচীন টেন্ডুলকর ও সৌরভ । দুজনের প্রথম উইকেটে সেঞ্চুরি পার্টনারশিপ ২৬ টি । একদিনের ম্যাচে মােট রান ১১,০০০ | একদিনের ম্যাচে নিজস্ব সেঞ্চুরি— ২১ টি । 

        সমস্ত কিছু ভুলে গেল তারা । নির্বাচক দলের কানে কি মন্ত্র শােনানো হল কে জানে ! এরপর ইরানি ট্রফি থেকেও বাদ পড়লেন তিনি । নির্বাচকমণ্ডলীর সভাপতি তখন দিলীপ বেঙ্গসরকার । যে সৌরভের নেতৃত্বে ভারত সবচেয়ে শক্তিশালী দল অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়েছে , তাদেরই মাটিতে হারিয়েছে ইংল্যান্ড , ওয়েস্ট ইন্ডিজ , পাকিস্তানকে সেই সৌরভকে উপযুক্ত কোনাে কারণ ছাড়াই আবার বিতাড়িত করা হল দল থেকে । 

       বিবেক , বুদ্ধিহীন মিডিয়া আবার মুখর হল নিন্দায় । সৌরভ বুঝলেন ‘ এখানে প্রতিবাদ অর্থহীন । অর্থহীন যােগ্যতা প্রদর্শন । কিছুদিন পর শ্রীকান্ত বাের্ডের নির্বাচক হয়ে এসে সৌরভকে আবার ফিরিয়ে আনলেন দলে । কিন্তু না । ততােদিনে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছেন সৌরভ । অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে এবার প্রথমদিন মাঠে নেমেই জানিয়ে দিলেন , বিশ্বক্রিকেট থেকে অবসর নিচ্ছেন । আর খেলবেন না তিনি । ভেবেছিলেন ফেরার সময় চিরশত্রু অস্ট্রেলিয়াকে , গ্রেগ চ্যাপেলের অস্ট্রেলিয়াকে একটি সুন্দর সেঞ্চুরি উপহার দিয়ে যাবেন , কিন্তু একটুর জন্য হল না । ৮৫ রানেই সন্তুষ্ট থাকতে হল । কিন্তু দল জিতল । অস্ট্রেলিয়ার হল ভরাডুবি । দীর্ঘ কুড়ি বছর পর টেস্টে ম্যাচের ব্যবধানে হারল তারা । লর্ডসের মাঠে যে সূর্যোদয় হয়েছিল ১৩ বছর আগে , নাগপুরের মাঠে তা হল অস্তগামী । কিন্তু সূর্যের অস্তিত্ব কে অস্বীকার করবে ? সেদিন যে ছেলেটিকে সবাই অবহেলা করেছিল আজ তিনিই ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড এর প্রেসিডেন্ট ।

       সৌরভ গাঙ্গুলী শুধু একজন চূড়ান্ত সফল বাঁহাতি ক্রিকেটার নন , তিনি অটুট মনােবলের প্রতীক । কিছুতেই ভেঙে না পড়ার , হার না মানার অপর নামই হল সৌরভ গাঙ্গুলী । নীচতা , সংকীর্ণতা আর আবেগ দুর্বলতার উর্ধ্বে ১০০ ভাগ পেশাদারিত্বের নাম সৌরভ গাঙ্গুলী । মানুষ যে পাথর তার দিকে ছুড়ে দিয়েছিল তাই দিয়েই তিনি তৈরি করেছিলেন তার ইমারত । 

        Adversity causes some men to break , others to break records .

                                              – Villiam A Ward

মাসুদুর রহমানের সফলতার কাহিনী | Best Powerful Motivational Success Story | Bangla Motivational Success Story |

মাসুদুর রহমানের সফলতার কাহিনী | Best Powerful Motivational Success Story | Bangla Motivational Success Story |

 মাসদুর রহমান 

     ঘট ঘটাং ঘট ঘটাং শব্দ করতে করতে ইস্পাত বাঁধানাে লাইনের ওপর দিয়ে বেগে ধেয়ে আসছে একটা মালগাড়ি । সেদিকেই স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে চুপ করে বসেছিল ছেলেটি গাছের ডালে । রেললাইনের ঠিক পাশেই ঝাকড়া গাছ । গাড়ি গাছের কাছে এলেই এক লাফে ঝাঁপিয়ে পড়বে গাড়ির ছাদে । তারপর স্কুলের কাছ বরাবর এসেই আর একটা লাফ দিয়ে নেমে পড়তে হবে । এই ছিল তার প্ল্যান । পাড়াগাঁয়ের ছেলে । লাফঝাপ মারাতে ভয় দূরে থাক প্রচণ্ড উৎসাহ তার ।

      প্রায় ২ কিমি দূরে ছেলেটির স্কুল । প্রতিদিন যাতায়াতে প্রায় আধঘণ্টা সময় লাগে । কিন্তু সেদিন বাড়ি থেকে বের হতেই দেরী হয়ে গেছে । তাই ছেলেটি মাথা খাটিয়ে এক বুদ্ধি বার করল । মালগাড়ির ছাদে একবার চেপে বসতে পারলে আর চিন্তা নেই । মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই অনায়াসে পৌছে যাওয়া যাবে ২ কিমি পথ । সময়ও বাঁচবে , স্কুলেও বকুনি খেতে হবে না । ক্রমে একেবারে কাছে এসে পড়ল মালগাড়িটি । ছেলেটি সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে পড়ল ছাদে । কিন্তু চলন্ত গাড়ির বেগের সঙ্গে তাল রাখতে না পেরে পা হড়কে পড়ে গেল লাইনের ওপর । মালভর্তি ভারী গাড়ির চাকা একের পর এক গড়িয়ে চলে গেল তার দুটি পায়ের ওপর দিয়ে । হাসপাতালে নিয়ে যাবার পর দুটি পা - ই হাঁটু থেকে অপারেশন করে বাদ দিতে হল । জন্মের মতাে পঙ্গু হয়ে গেল ছেলেটি । 

      গরিব ঘরের পঙ্গু খোঁড়া ছেলে । সবাই একবাক্যে বলল বাকি জীবনটা ভিক্ষে করে খেতে হবে ওকে । হ্যা , ভিক্ষে করে কারণ এভাবেই এই ভারতবর্ষের লক্ষ লক্ষ প্রতিবন্ধী মানুষ নিজেদের পেট চালাতে বাধ্য হয় ।

       কিন্তু না । আমাদের গল্পের এই নায়ক কিন্তু কিছুতেই এই অমােঘ ভবিতব্যকে মেনে নিতে চায়নি । ভিক্ষে নয় , এক সুস্থ , স্বাভাবিক , সসন্মান জীবনই গড়ে তুলব আমি প্রতিজ্ঞা করল সে মনে মনে । আজ সারা বিশ্বের মানুষ সবিস্ময়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে , তার নামে । জয়ধ্বনি দেয় । বিশ্বের বুকে স্বদেশের বিজয় পতাকা উড়িয়ে দিয়েছে , সেদিনের সেই পঙ্গু মূখ পল্লী বালকটি । 

      এতােক্ষণে নিশ্চয়ই ছেলেটিকে চিনতে পেরেছাে তােমরা ? হ্যা , ইনিই বিখ্যাত সাঁতারু , ইংলিশ চ্যানেল , জিব্রালটার প্রণালী সহ পৃথিবীর নানা দুরূহ সমুদ্রযােজক বিজয়ী বীর বঙ্গসন্তান— মাসদুর রহমান বৈদ্য । তীব্র ইচ্ছাশক্তি আর গভীর আত্মবিশ্বাসের কাছে যে পৃথিবীর কোনাে বাধাই বাধা নয়- একথা বিশ্ববাসীকে আরাে একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন মাসদুর । 

      মাসদুর রহমান বৈদ্য , শৈশবে যখন দুর্ঘটনায় নিজের দুটি পা হারালেন তখন তার বাবা - মা সহ পরিবারের সবাই হতাশায় ভেঙে পড়লেন । কিন্তু স্বয়ং মাসদুর নিজে হাল ছাড়লেন না কিছুতেই । জেদ চেপে গেল মনে । সুস্থভাবে বাঁচতেই হবে , স্বাভাবিকভাবেই হাঁটাচলা করতেই হবে । লােকে যখন তার দিকে করুণার দৃষ্টিতে তাকাতে , আহারে ! খোঁড়া বেচারা ! বালে অনুকম্পা প্রকাশ করত কিংবা
বিজ্ঞাণ বাণে বিদ্ধ করত তখন কোনাে কোনাে সময় নিজেকে বড়াে দুর্ভাগা মনে হতাে তার । তার প্রতি এই অবিচার করার জন্য নিদারুণ অভিমান হাত ঈশ্বরের প্রতি । কখনাে বা নিজের অজান্তেই মনের অবচেতনে নিজেকে শেষ করে ফেলার ইচ্ছে জাগত । 

      এমনি সময় একদিন একজন মানুষের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল মাসদুরের । সেও হারিয়েছে দুটি পা । তবু সে ভিক্ষাজীৰী নয় । অন্যের করুণার পাত্র নয় । নিজের স্ত্রী ও তিনটি কন্যাকে নিয়ে দিব্যি সংসার তার এবং সম্পূর্ণ একার রােজগারে সে - ই এই বৃহৎ পরিবারটির ভরণপােষণ করে । সমাজের আর পাঁচজন সুস্থ নাগরিকের মতােই সম্মানীয় স্বাভাবিক জীবন তার ।

       নিজের চোখের সামনে এইরকম জীবন্ত উদাহরণ দেখে মাসদুর উজ্জীবিত হয়ে উঠলেন নতুন প্রেরণায় । পুণেতে গিয়ে লাগিয়ে নিলেন বিকল্প পা । ক্রাচ ফেলে দিয়ে নিজের পায়ের ওপর সােজা হয়ে দাঁড়ালেন । আকাশের দিকে দুই হাত তুলে বললেন আমি পারব আমরা পারব- আমরাও পারি । নকল প্রত্যঙ্গকে নিজের শরীরের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে গেলে প্রথম প্রথম খুব যন্ত্রণা হয় । এই যন্ত্রণা সহ্য করেই হাঁটাচলা করতে হয় । একটু একটু করে হাঁটাচলা করতে করতে নকল পা আসল পায়ের মতােই সহজ হয়ে ওঠে ।

      মাসদুরের ক্ষেত্রেও তাই হল । অনেক যন্ত্রণা ও অভ্যাসের পর বিকল্প পা শরীরের সঙ্গে ঠিকভাবে সংযুক্ত হল । আর তারপর থেকেই শুরু হল মাসদুর রহমান বৈদ্যের বিশ্ববিজয়ের রথযাত্রা । 

       ছােটো থেকেই খেলাধুলা করতে ভালােবাসতেন । পা ঠিক হবার পর ছােটোখাটো ক্রীড়া প্রতিযােগিতায় নাম দিতে লাগলেন । অনেকটা যেন নিজের প্রতিই নিজে ছুড়ে দিয়েছিলেন কঠিন চ্যালেঞ্জ । দেখি পারি কিনা , কেন পারব না— পারতেই হবে । এই কঠিন জেল নিয়েই নকল পা-ওলা মানুষটি সেবার যােগ দিলেন বড়ােসড়াে sports fourTinnerst এ । 17 টি ইভেন্টের মধ্যে 16 টিতেই জয়ী হলেন তিনি , তার মধ্যে চারটি ছিল সাঁতারের ইভেন্ট । সেদিন ভিকট্রি স্ট্যাম্পের ওপর দাঁড়িয়ে শত শত দর্শকের হাততালির সামনে পুরস্কার গ্রহণ করতে করতে একটাই প্রতিজ্ঞা মনের গভীরে রােপণ করলেন মাসদুর - সাঁতার , শুধু সাঁতারই এবার থেকে হবে তার লড়ায়ের অস্ত্র । এই নকল পা নিয়েই ইংলিশ চ্যানেল পার হতে হবে তাকে । দেখিয়ে দিতে হবে বিশ্বের মানুষকে যে প্রতিবন্ধী মানেই করুণার পাত্র নয় ঘৃণার পাত্র নয় । তারাও ছিনিয়ে নিতে পারে শ্রেষ্ঠের সম্মান , মাথায় পরতে পারে বিজয়ীর মুকুট । 

       শুরু হল জোরদার অনুশীলন আর সেইসঙ্গে স্পনসর যােগাড় করার চেষ্টা । আমাদের এই হতভাগ্য দেশে আজও খেলাধুলার প্রয়োজনে বিদেশ যেতে হলে স্পনসরের অপেক্ষায় তাকিয়ে থাকতে হয় । কারো ভাগ্যে শিকে ছেড়ে , কারাে ভাগ্যে ছেড়ে না । তার প্রতিভা কুঁড়িতেই ঝরে যায় । 

      যাইহােক , মাসদুর রহমানের ভাগ্য কিছুটা ভালাে ছিল । 1997 সালে ইংলিশ চ্যানেল সাঁতারে পার হয়ে গেলেন তিনি । এর আগে তার মতাে আর কোনাে প্রতিবন্ধী এই বিপদসংকুল সমুদ্রখাল সাঁতরে পার হতে পারেনি । 2001 সালে মাসদুরের মুকুটে যুক্ত হল আরাে একটি অত্যুজ্জ্বল পালক । 32 বছর বয়সী এই যুবক ভীষণতম তরঙ্গসংকুল জিব্রালটার প্রণালী মাত্র 4 ঘণ্টা 20 মিনিটে সাঁতরে পার হয়ে গেলেন । তার আগে পৃথিবীর আর কোনাে দুই পা হারানাে সাঁতারু এতাে বড়াে বিরল কৃতিত্বের অধিকারী হতে পারেনি । 

      বর্তমানে মাসদুর রহমানকে নিয়ে একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হতে চলেছে । ডাইরেক্টর খােকন চক্রবর্তীর নির্দেশনায় । নাম আশা । প্রধান চরিত্রে অভিনয় করছেন মাসদুর রহমান নিজেই । শারীরিক প্রতিবন্ধী যে সমাজ ও পরিবারের বােঝা নয় , একটু সাহায্য বা সসম্মান সহযােগিতা পেলে তারাও যে প্রমাণ করতে পারে নিজেদের , এটাই এই চলচ্চিত্রের অন্তর্নিহিত বার্তা । 

       এই সিনেমার গল্পে দেখানাে হয়েছে একজন মহিলা , প্রতিবন্ধী সন্তানের জন্ম দেওয়ার অপরাধে সমাজে ও পরিবারে এতােদুর অত্যাচারিত হয়েছেন যে দুঃখে হতাশায় আত্মহত্যা করতে উদ্যত হয়েছেন । মাসদুর রহমান তাকে শেষপর্যন্ত আত্মহত্যা থেকে বিরত করবেন এবং তার প্রতিবন্ধী সন্তানকেও পথ দেখাবেন সুন্দর আলােকিত জীবনের । 

       মাসদুর কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করা সত্ত্বেও কোনাে পারিশ্রমিক নিচ্ছেন না এই ছবির জন্য । অমিতাভ বচ্চন অভিনীত ‘ ব্ল্যাক ’ ছবিটি দেখার পর তার মনে হয়েছে এ ধরনের ছবি আরাে বেশি বেশি করে তৈরি হওয়া প্রয়ােজন । তাই সহস্র ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি অভিনয়ের জন্য সময় বার করে নিয়েছেন । তুলে ধরতে চলেছেন নিজের অনবদ্য জীবনের রূপকথা কোটি কোটি দর্শকের সামনে । কোটি কোটি আশাহত হৃদয়ে হাল না ছাড়া , হার না মানা সঞ্জীবনী মন্ত্র ছড়িয়ে দেবার উদ্দেশ্যে । 

       A successful man is he who can lay firm foundation with the bricks that others throw at him .

লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি এর সফলতার কাহিনী | Best Powerful Motivational Success Story In Bengali | Leonardo Da Vinchi

লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি এর সফলতার কাহিনী | Best Powerful Motivational Success Story In Bengali | Leonardo Da Vinchi

 লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি

      দ্যা ভিঞ্চি কি কি পারতেন তা না বলে তিনি কি পারতেন না তা বললে বােধহয় তার পরিচয় দেওয়াটা অনেক সহজ হয় । কি না ছিলেন তিনি ? 

     একদিকে অসাধারণ চিত্রশিল্পী , অসাধারণ স্থপতি । অন্যদিকে তিনিই আবার সিভিল এবং মেকানিক্যাল ইঞ্জিনীয়ার । অনন্য পদার্থবিদ আবার যে কোনাে অঙ্ক মুহূর্তের মধ্যে কষে ফেলার মতাে অনন্যসাধারণ গাণিতিক যুদ্ধের অস্ত্রশস্ত্র বানানাের কৌশলে পৃথিবীতে তিনি অদ্বিতীয় আবার তারই চোখে প্রথম ধরা পড়েছে জীববিজ্ঞানের গৃঢ়তম বহু রহস্য । তার তৈরি মূর্তিগুলির দিকে তাকিয়ে মানুষ ধন্দে পড়ে যায়— মূর্তিগুলাে মূর্তিমাত্র না জীবন্ত মানুষ সহজে বুঝতে পারে না । 

       এমন আশ্চর্য প্রতিভাধর অলৌকিক মেধাসম্পন্ন মানুষটি কিন্তু জীবনে কোথাও কখনাে তার যােগ্য মর্যাদা পাননি । শুধুমাত্র একটু সসম্মানে বেচে থাকা আর নিজের সৃষ্টিতে ডুবে থাকার মতাে এক টুকরাে নিরিবিলি নিরাপদ জায়গার সন্ধানে সারাটা জীবন তিনি এক শহর থেকে আর এক শহরে ছুটে বেড়িয়েছেন তাড়া খাওয়া জন্তুর মতাে । কিন্তু ইটালির ক্ষমতাসীন রাজা মহারাজারা কোনাে সহানুভূতি দেখাননি তার প্রতি বরং তাকে প্রাণপণে খাটিয়ে নিয়েছেন নিজেদের স্বার্থে । 

       তবু হাল ছাড়েন নি , ভেঙে পড়েননি ইটালির এই মহামানব । জীবনের লাগাতার দুর্যোগের মাঝখানে বসেও নিরন্তর সৃষ্টি করে গেছেন তিনি । তার আঁকা মােনালিসা , দ্য লাস্ট সাপার আজও বিশ্বের শিল্পরসিকদের বিস্ময়ে নির্বাক করে রাখে ।

        লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি ইটালি দেশের ফ্লরেন্সে ভিঞ্চি নামক এক ছেটো শহরে ১৪৫২ খ্রিস্টাব্দের ১৫ এপ্রিল জন্ম নেন । বড়াে হবার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর বহুমুখী প্রতিভার খ্যাতি ইটালির কোণে কোণে ছড়িয়ে পড়তে থাকে । ফ্লোরেন্সের রাজা তখন মেদিচিরা । তিনি শিল্পসংস্কৃতির সমঝদার ও পৃষ্ঠপােষক । তিনি লিওনার্দোর কথা শুনে তাঁকে ডেকে পাঠালেন । সহজেই রাজসভায় ঠাই হয়ে গেল তার । রাজা মেদিচিরা দ্যা ভিঞ্চির জন্য আরামবিলাসের অঢেল ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন । সেইসঙ্গে ছিল সৃষ্টিতে মগ্ন থাকবার মতাে প্রচুর অবকাশ । দ্যা ভিঞ্চি ভাবলেন জীবনের তরীটা তবে স্বচ্ছন্দেই ভেসে যাবে বুঝি । কিন্তু বাস্তবে তা হলাে না । 

       রাজার নিয়ম ছিল এই যে তার সভায় লিওনার্দোকে নিয়মিত উপস্থিত থাকতে হবে । থাকতেনও । শিল্প ছাড়াও রাজসভায় বিজ্ঞান , দর্শন , অর্থনীতি ইত্যাদি নানা প্রসঙ্গ উঠত । দ্যা ভিঞ্চি সব বিষয়েই জানাতেন তার একান্ত অভিনব চাঁছাছােলা মতামত । 

      কিন্তু এসব মত অভিজ্ঞদের সঙ্গে মিলত না । মিললেও তারা সব ব্যাপারেই তার মাথা গলানােটা পছন্দ করতেন না । তারা বলতেন লিওনার্দো তার নিজস্ব চিত্রশিল্প নিয়েই থাকুন না , আমাদের ব্যাপারে কথা বলব আমরাই । এতােদিন যাঁরা বিজ্ঞানে , দর্শনে , চিকিৎসা , শাস্ত্রে মহাপণ্ডিত বলে গণ্য হতেন— লিওনার্দো সভার মাঝখানেই তাদের ভুল চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতেন ।

      রাজসভায় অনেক শত্রু তৈরি হয়ে গেল তার । তারা রাজার কাছে ক্রমাগত তার নামে নালিশ আনতে লাগলেন । বিরক্ত হয়ে রাজা একদিন সভায় ডেকে পাঠালেন তাঁকে । বললেন- আপনার খ্যাতি চিত্রকর হিসাবেই । অন্য কোনাে বিষয়ে কোনাে মন্তব্য করতে যাবেন আপনি । অনেক নামী দামী প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি আপনার কথায় অপমানিত হয়েছেন । তাই আপনার লজ্জিত হওয়া উচিত । নিজের চরকায় তেল দিন । অন্যের ব্যাপারে নাক গলাতে আসবেন না । 

       রাজার কাছে এহেন ধমক খেয়ে খুবই মর্মাহত হয়ে পড়লেন দ্যা ভিঞ্চি । এরপর থেকে নীরবে সভার একটি কোণে চুপ করে বসে থাকতেন । মিথ্যে এবং ভুল কোনাে কথা নিয়ে সবাই হৈ হৈ করত , সব নীরবে সহ্য করতে হত তাকে । সবাই তাঁকে অবজ্ঞা করত , উপেক্ষা করত । তিনি নীরবে হজম করতেন । 

    একটা সময় আর পারলেন না । একদিন এক শীতের রাতে ফ্লোরেন্সের রাজপ্রাসাদ থেকে সপরিবারে পালালেন । চোরের মতাে । লুকিয়ে , অপরাধীর মতাে মাথা নীচু করে । চুপি চুপি পালালেন , কারণ ধরা পড়লেই হয় প্রাণদণ্ড নয় যাবজ্জীবন কারাবাস । তাই ইটালির সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষটিকে নিজের স্বদেশ থেকে চোরের মতাে চুপিচুপি পালাতে হল শুধু অকপটে সত্য কথা বলার অপরাধে । 

      ফ্লোরেন্স থেকে পালিয়ে দ্যা ভিঞ্চি এলেন মিলানে । মিলানের রাজা ফোর্জা ছিলেন ভয়ানক যুদ্ধবাজ । দ্যা ভিঞ্চি তাকে একটি চিঠি লিখে পাঠালেন । লিখলেন যে তিনি একজন বৈজ্ঞানিক ও যন্ত্রবিদ । অসাধারণ সব যুদ্ধের অস্ত্র তিনি তৈরি করেছেন যা ব্যবহার করলে ফোর্জা সমগ্র ইতালিকে পরাজিত করতে পারবেন । তিনি করেছেন বিশেষ ধরনের এক সেতু যা মুড়ে নিয়ে সর্বত্র যাওয়া যায় । আবার দরকার মতাে সেটি খুলে নিয়ে অনায়াসে পেরােনাে যায় দুরন্ত পাহাড়ী নদী । সেতুটি যেমন হালকা , তেমনি তা আগুনে পােড়ে না , অস্ত্রে কাটে না , জলে ডােবে না । আবার দারুণ শক্তও । সহজে ভাঙ্গে না, দোমড়ায় না । 

      আমার তৈরি এক বিশেষ ধরনের কামান থেকে অনবরত ছোঁড়া যায় বড় বড় পাথরের খণ্ড । অথচ কামানটি ছােটো ও হালকা , সহজে পরিবহনযােগ্য । 

     আমি এমন একটা চমৎকার দাহ্য পদার্থ বানিয়েছি যাতে আগুন ছোঁয়ালেই চারিদিক ধোঁয়ার ঢেকে যাবে আর শত্রুপক্ষ অন্ধকারে দিশাহারা হয়ে সহজেই ধরা পড়ে যাবে । 

      আমি একজন অসামান্য স্থপতি । এমন কিছু অপূর্ব নক্সা আমি করেছি যার সাহায্যে আপনার এই মিলান শহরকে বিশ্বের সুন্দরতম শহর করে তােলা যাবে । আমার তৈরি মূর্তিগুলি শহরকে পৃথিবীবাসীর কাছে আকর্ষণীয় করে তুলবে । 

     দয়া করে একবার আমার কথাগুলাের সত্যতা পরীক্ষা করে দেখুন । যদি একটি কথাও ভুল হয় তবে যে কোনাে শাস্তি আমি মাথা পেতে নেব । এই চিঠিতে নিজের ছবি বা ভাস্কর্যের বিষয়ে বিশেষ কিছু বলেন নি দ্যা ভিঞ্চি । তার কারণ তিনি ভালাে করেই জানতেন যে যুদ্ধবাজ রাজার কাছে ওসবের বিন্দুমাত্র দাম নেই । সে যাই হােক , মিলানের রাজা ফোর্জ দ্যা ভিঞ্চিকে সাদরে ঠাই দিলেন সভায় । 

       এরপর , দ্যা ভিঞ্চির তৈরি যুদ্ধাস্ত্রগুলি ব্যবহার করে একের পর এক যুদ্ধজয় করে চললেন রাজা ফোর্জা । একের পর এক দেশ জয় করতে করতে যুদ্ধটা তার ঘাড়ে একেবারে ভূতের মতাে চেপে বসল । যুদ্ধজয়ের নেশায় তিনি একেবারে উন্মাদ হয়ে গেলেন । যাকে তাকে যখন তখন একেবারে নিকেষ করে দেয়াটাই একটা মজার খেলা হয়ে দাঁড়াল তার ।

       দ্যা ভিঞ্চি বুঝলেন এরকম আধপাগলা লড়াইবাজ লােকের আশ্রয়ে থাকাটা মােটেই নিরাপদ নয় । যদি কোনাে যুদ্ধে দৈবাৎ হার হয়ে যায় । সেদিনই তিনি দ্যা ভিঞ্চিকে হয় হত্যা করবেন নয় চরম অপমান করে তাড়িয়ে দেবেন । 

       তাই তলে তলে আবার নতুন আশ্রয়ের খোঁজ করতে লাগলেন তিনি । চিঠি লিখলেন খ্রিস্টান সমাজের মাথা মহামান্য পােপকে। পােপ দ্যা ভিঞ্চির সব কথা জানলেন কিন্তু তার চিঠির কোনাে উত্তর দিলেন না । 

       দ্যা ভিঞ্চি এবার আশ্রয় নিলেন সিজার কের্জিয়ার কাছে । ইনি রাজা মহারাজা না হলেও অর্থ ও ক্ষমতা ছিল প্রচুর । দ্যা ভিঞ্চির । প্রতিভার পরিচয় পেয়ে তিনি তাঁকে সাদরে আশ্রয় দিলেন নিজের অট্টালিকায় । 

      আগের অভিজ্ঞতায় দ্যা ভিঞ্চি সাবধানী হয়ে গিয়েছিলেন । কথাবার্তা বলেন খুব সতর্কভাবে । ভয়ে ভয়ে চুপচাপ থাকেন , ক্ষমতাশালী লােকেদের পারৎপক্ষে ছায়া মাড়ান না । 

       এখানে তার পদ ছিল জনৈক সিভিল ইঞ্জিনীয়ারে সহকারী । এই সামান্য তুচ্ছ একটি পদে কাজের সুযােগ , সৃষ্টির সুযােগ বা প্রতিভা ব্যবহারের সুযােগ একবিন্দু নেই । নেই উদ্ভাবনের কোনাে প্রয়ােজনও । তবু হাল ছাড়লেন না দ্যা ভিঞ্চি । নিজের দুর্ভাগ্যকে শান্তভাবেই মেনে নিলেন তিনি । নিঃশব্দে কাটিয়ে দিলেন একে একে এগারােটি বছর । জীবনের গ্লানিময় এই এগারােটি বছরের একঘেয়ে জীবনের দুঃখ ও ব্যর্থতা ভুলতে অবসর সময়ে নিজের ঘরের এক কোণায় বসে ছবি আঁকতেন দ্যা ভিঞ্চি । একের পর এক আঁকা হয়ে গেল মােনালিসা , দ্যা ক্রিয়েশন অব ম্যান , সিস্টিন চ্যাপেল , লাস্টসাপার প্রভৃতির মতাে দুর্ধর্ষ অতুলনীয় সব ছবি বিশ্বের বাজারে যার দাম কোটি কোটি টাকা । 

       এগারােটি বছর নিঃসঙ্গ জীবন কাটাবার পর আরও একবার পােপের কাছে আশ্রয় ভিক্ষা করে আবেদন করলেন দ্যা ভিঞ্চি । এবার পােপের মন গলল । আশ্রয় পেলেন দ্যা ভিঞ্চি কিন্তু মর্যাদা পেলেন না । পােপ তাঁকে ঢুকিয়ে দিলেন অদ্ভুত একটি কাজে । তাঁর নিজস্ব । টাকশালাটির দেখভাল করার কাজ । 

       স্বপ্নভঙ্গের নিদারুণ হতাশায় হাহাকার করে উঠল এই মহাপ্রতিভাধর শিল্পীর হৃদয় । কিন্তু কিই বা করার আছে তার অদৃষ্টকে মেনে নেওয়া ছাড়া ? কেটে গেল আরাে চার বছর । দীর্ঘদিনের । চাপা দুঃখ আর হতাশা ততােদিনে কামড় বসিয়েছে তার স্বাস্থ্যে । দিন দিন ক্ষীণ হতে লাগল দৃষ্টিশক্তি । 

      তবু দ্যা ভিঞ্চি হাল ছাড়লেন না । প্রৌঢ় বয়সেও তিনি স্বপ্ন দেখতে লাগলেন পৃথিবীর কোনাে না কোনাে প্রান্তে কেউ না কেউ একদিন ঠিক বুঝতে পারবে তার দাম আর সেদিন তিনি কড়ায় গণ্ডায় উশুল । করে নেবেন জীবনের যতাে বকেয়া পাওনা । 

       এই স্বপ্ন বুকে নিয়েই আবার এক দিন ইটালি ছেড়ে ফ্রান্সের পথে পা বাড়ালেন তিনি । জাত শিল্পী , ফরাসিরা লুফে নিল তাঁকে । শত শত কণ্ঠে উঠল প্রশংসা আর স্তুতি । আবার নতুন করে মেতে উঠলেন শিল্পী সৃষ্টির আনন্দে । জীবনের শেষ দুটি বছর নিজেকে উজাড় করে দিলেন তিনি । ইটালির মাটিতে ১৫১৯ খ্রি . শেষ নিঃশ্বাস ফেলার আগে তিনি যেন সদর্পে ঘােষণা করে গেলেন— যা শ্রেষ্ঠ তার জয় হবেই হবে । হাল ধরে যে বসে থাকে তার তরী একদিন সাফল্যের কূলে ঠিকই পৌছে যায় । 

        God sees the truth but waits .

পল এহর্লিকের সফলতার কাহিনী। Best Powerful Motivational Success Story In Bengali । Bangla Success Story

পল এহর্লিকের সফলতার কাহিনী। Best Powerful Motivational Success Story In Bengali । Bangla Success Story

 পল এহর্লিক 

         সহজ বাংলায় যাকে বলে একগুঁয়ে , জার্মান ডাক্তার পল এহর্লিক ছিলেন তাই । এই গো বা জেদ কেউ যদি কোনাে ভালাে কাজে লাগায় তাহলে অসাধ্য বলে কিছুই থাকে না । অন্তত পল এহর্লিককে দেখলে সে কথাটা সকলেই স্বীকার করবে । 

      আমি যে সময়ের কথা বলছি সে সময় সিফিলিসের কোনাে ওষুধ ছিল । । বিষাক্ত ঘা - এর যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে কতাে রােগী তিল তিল করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেত । এমন কোনাে ওষুধ তখনাে আবিষ্কৃত ছিল না যাতে তাদের বাঁচানাে যায় কিংবা ঘায়ের যন্ত্রণা এতােটুকু কমানাে যায় । 

       পল এহর্লিক ছিলেন ডাক্তার । তার হাসপাতালে প্রতিদিন অনেক সিফিলিস আক্রান্ত রােগী আসত । তিনি তাদের ভর্তি করে নিতেন । কিন্তু ওই পর্যন্তই । হাসপাতালের বেডে শুয়ে শুয়ে যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে অসহায় মৃত্যুর কোলে ঢেলে পড়ত তারা । 

       প্রতিদিন রােগীদের এই অসহায় ছটফটানি দেখতে দেখতে পলের মনে দৃঢ় কঠিন এক সংকল্প জাগল । যে করেই হােক , এ রােগের ওষুধ বের করতেই হবে । সারাদিন হাসপাতালে রােগী দেখতেন । তারপর সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরেই ঢুকে যেতেন গবেষণাগারে । রাতের পর রাত কেটে যেত নানারকম ওষুধপত্র নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষায় । একাগ্র মনে কাজ করতে করতে কখন যে রাত কেটে গিয়ে ভাের হয়ে যেত খেয়ালই থাকত না তার । দীর্ঘশ্বাস ফেলে শ্রান্ত ক্লান্ত দেহে পরীক্ষাগার থেকে বেরিয়ে আসতেন । ঘুম জড়ানাে লাল লাল চোখে আয়নার দিকে তাকিয়ে হতাশভাবে বলতেন- নাঃ , আজও হলাে না । আরও একটা দিন ব্যর্থ হয়ে গেল । 

      একদিন , দুদিন নয়— দিনের পর দিন , মাসের পর মাস চলতে লাগল । পরীক্ষা নিরীক্ষা । একটি দিনের জন্যেও বাদ পড়ল না । একটি বারের জন্যেও মনে হল না , দূর , আমার দ্বারা হবে না , এ অন্য কেউ করবে । 

       একটি মুহূর্তের জন্যও আত্মবিশ্বাস হারালেন না । বরং প্রতিদিনের ব্যর্থতা আরাে দৃঢ় করল তার প্রতিজ্ঞা । জেদ আরাে চেপে ধরল শক্ত করে মস্তিষ্কের ঝুঁটি । 

       হয়তাে কোনােদিন সারা রাত অতিরিক্ত পরিশ্রমের পর শরীর মন  অবশ হয়ে গেছে । পা আর চলছে না । ঘুমে ঢলে পড়েছে চোখ । মন বলছে , আর না- এবার থামা উচিত । 

      এমনি সময় হাসপাতালে এসেছেন । রােগীদের কাতর আর্তনাদ আর অসহায় মৃত্যু নতুন করে প্রতিজ্ঞা জমিয়ে তুলেছে তার অন্তরে । আবার ছুটে গেছেন গবেষণাগারে । নতুন করে শুরু করে দিয়েছেন কাজ ।

       মােট 418 বার পরীক্ষা করা হয়ে গেল । তবু হাল ছাড়লেন না । পলের গবেষণার কথা তখন অনেকের কাছেই পৌঁছে গিয়েছে । এঁদের মধ্যে একজন হলেন ডাক্তার হাজ । জাপানে বাড়ি । তার মনে হল পলকে তার সাহায্য করা উচিত । দেশ ছেড়ে , ঘরবাড়ি কাজকর্ম ফেলে এগিয়ে এলেন তিনি । এবার দুজনে মিলে যৌথভাবে চালাতে লাগলেন পরীক্ষা । 

       এতাে শুধু ওষুধের পরীক্ষা নয় , এ যেন তাদের ধৈর্যের পরীক্ষা ।দৃঢ়তার পরীক্ষা । যত দিন যায় ততােই যেন আশা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে থাকে । নিজের সঙ্গেই শুরু হল লড়াই । না , কিছুতেই হার মানলে চলবে না ।

       শুরু যখন করেছেন , তখন শেষও তাদেরকেই করতে হবে । এক এক করে ' 605 বার পরীক্ষা চালিয়ে গেলেন পল ও হাজ যৌথভাবে । প্রতিটি বারই বিপুল প্রত্যাশা নিয়ে শুরু আর শেষে ঘাম মুছে পরস্পরের হাতে হাত রেখে প্রতিজ্ঞা আগামী বারটির জন্যে । অবশেষে ৬০৬ তম পরীক্ষার ফল এলাে ইতিবাচক । আনন্দে চীৎকার করে উঠলেন সমস্বরে হয়েছে হয়েছে , পেয়েছি উই হ্যাভ ডান , উই হ্যাভ ডান ইট । সিফিলস রােগের জীবাণুকে খতম করতে সক্ষম এমন ওষুধের সন্ধান মিলেছে । বিজ্ঞানীরা ওষুধ তৈরি করে নাম রাখলেন সালভার্সান ।

        কিন্তু তাতেও পুরােপুরি সন্তুষ্ট হতে পারলেন কৈ ? এ ওষুধে মােটামুটি কাজ চলে যায় বটে কিন্তু ফল ঠিক আশানুরূপ নয় । অগত্যা আবার সেই গবেষণাগার । আবার সেই এক্সপেরিমেন্ট , সেই রাত্রি । জাগরণ , সেই আশা নিরাশার দোলায় দোল । 

        এভাবেই চলতে চলতে অবশেষে ৯১০ বারের মাথায় ফল এলাে আশ্চর্যজনক । দুজনেই চমকে উঠলেন পল এহর্লিক ও ডাক্তার হাজ । আনন্দে দিশাহারা হয়ে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরলেন তারা । 

      দীর্ঘদিনের লড়ায়ের সঙ্গী দুই বন্ধু পরস্পরকে দুহাতে ধরে আনন্দে ঝকানি দিতে দিতে আনন্দে চীৎকার করতে লাগলেন — ইউরেকা ! ইউরেকা !

      হ্যাঁ ! ৯১০ বার পরীক্ষা চালানাের পর এসেছিল সাফল্য । এর মধ্যে কোনাে এক হতাশার মুহূর্তে তারা যদি এক্সপেরিমেন্ট চালানাে বন্ধ করে দিতেন , যদি হাল ছেড়ে দিতেন—

        কি হত বলাে তাে ? সিফিলিসের রােগীরা , আজও হয়তাে করত মর্মন্তুদ আর্তনাদ । ইতিহাসের কোথাও পল এহর্লিক বা হাজের নাম লেখা থাকত না স্বর্ণাক্ষরে ।

       সবচেয়ে বড় কথা— জীবনের এক সর্বোত্তম আনন্দের , মহােত্তম অভিজ্ঞতার স্বাদ কোনােদিনই তারা পেতেন না । যে আনন্দের দাম যতাে বেশি সে আন্দদের স্বাদও তত মধুর আর দীর্ঘ ।

        The sweetness of rest comes from the bitterness of labour .

আমাদের আর ও মহিয়সীদের সফলতার কাহিনী :-

ভীম রাও আম্বেদকরের সফলতার কাহিনী | Best Powerful Motivational Success Story | Bangla Success Story |

ভীম রাও আম্বেদকরের সফলতার কাহিনী | Best Powerful Motivational Success Story | Bangla Success Story |

 ভীম রাও আম্বেদকর 

        আম্বেদকর তাঁর পৈতৃক উপাধি নয় । ওই উপাধিটি তার স্কুলের হেডমাস্টার মশাই - এর । কিন্তু কেন এরকম হল ? একটা মানুষ সারাটা জীবন তার নিজের পিতৃ - পিতামহের উপাধি ব্যবহার করতে কেন পারলেন না ? কেনই বা তিনি সারাজীবন অন্যের উপাধি বয়ে বেড়াতে বাধ্য হলেন ? শােনাচ্ছি সে ইতিহাস । সে বড়ােই করুণ , বড়ােই লজ্জার কাহিনি । 

       এক দলিত পরিবারে চরম দারিদ্রের মধ্যে জন্ম ভীমরাও রামজী সকপাল আম্বেদকরের । বাবা রামজী সকপাল আর মা ভীমাবাঈ । বাড়িতে বারাে তেরােটি ভাই বােন , ঘরে দারিদ্রের যন্ত্রণা । বাইরে সমাজের যন্ত্রণা । তারা যে দলিত , অচ্ছুত । তাঁদের স্পর্শ করে ফেললে উচ্চবর্ণের লােকেদের স্নান করতে হতাে । এক পাত্র থেকে খেলে কিংবা পাশাপাশি বসে খাবার খেলে তাে কথাই নেই । জাত যেত উচ্চবর্ণের
লােকেদের । তখুনি তাদের মাথা মুড়িয়ে , গােবর খেয়ে প্রায়শ্চিত্য করতে হত । কেউ আপত্তি করলে তাকে একঘরে করা হত । মানে সবাই তাকে এড়িয়ে চলতাে তার সাথে কথা বলা , দেওয়ানেওয়া বা মেলামেশা করত না । যাকে ইংরাজিতে বলে বয়কট করা । 

      এরকম দলিত ঘরের কোনাে ছেলের পক্ষেই স্কুলে গিয়ে পড়াশুনা করার প্রশ্নই ওঠে না । তাদের জন্মই যে মূর্খ হয়ে থাকা আর উচ্চবর্ণের সেবা করার জন্য । কিন্তু আম্বেদকরের ভাগ্যটা ভালাে ছিল । বাবা ইংরেজের সৈন্যবাহিনিতে চাকরি করতেন । সে সময় সরকার সৈনিকদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখার জন্য বিনা বেতনের স্কুল করে দিয়েছিলেন । সেখানেই শিক্ষার শুরু হল তার । কিন্তু বাবা চাকরি থেকে অবসর নিয়ে সাতারায় এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করলেন । ভীমরাওকে ভর্তি করে দেওয়া হল স্থানীয় প্রাথমিক স্কুলে ।। কিন্তু তিনি যে অস্পৃশ্য , তাকে ছুঁলে যে অন্য ছাত্রদের , এমনকি শিক্ষকদেরও জাত যাবে । তাই ছাত্রদের জন্য নির্দিষ্ট বেঞ্চে না বসে , ভীমরাওকে ক্লাসের এক কোণে মেঝেতে বসতে হত । খাতায় কিছু লিখে বা অঙ্ক কষে মাষ্টারমশাইকে দেখাতে এলে তিনি খাতাটি স্পর্শ করতেন না । অন্য ছাত্ররা মাস্টারমশাই - এর টেবিল ঘিরে দাঁড়িয়ে তাদের খাতা দেখাতাে আর ভীমরাও শুকনাে মুখে দাঁড়িয়ে থাকতাে দূরে । মাস্টারমশাইয়ের মুখে শুনে নিজে নিজেই সংশােধন করে নিত নিজের খাতা । ভাবতে পারাে ? অতটুকুনি একটি ছেলে , তাকে পাশের সহপাঠী থেকে শিক্ষক কেউ ভালােবাসে না , ছোঁয় না , কাছে টানে না । সে থাকে দূরে দূরে একা একা । কেন ? কি দোষ তার ? না , সে অস্পৃশ্য মাহারদের ঘরে জন্মেছে ।

        কিন্তু ভাগ্যটা ভীমরাও - এর নেহাতই ভালাে ছিল বলতে হবে । সবাই তাে আর সমান হন না । ওই স্কুলেই একজন সহৃদয় শিক্ষক ছিলেন । তিনি প্রতিদিন দেখতেন ছােট্ট ছেলেটির ওপর সমাজের অত্যাচার । স্কুলে এবং স্কুলের বাইরেও এই অত্যাচার চলতাে সমানে । অথচ এজন্য উঁচু জাতের ছেলেদের কোনাে ব্যাপারেই শাস্তি দেওয়া যাবে না কারণ সেটাই সমাজের প্রচলিত নিয়ম । সেই দয়ালু শিক্ষক তখন এক বুদ্ধি বের করলেন । তিনি শান্ত , ভদ্র , বুদ্ধিমান ভীমরাও - এর নামের সঙ্গে নিজের আম্বেদকর পদবীটা জুড়ে দিলেন । এতে নাম শুনেই নাক সিঁটকে ওঠেন যারা তাদের হাত থেকে কিছুটা অন্তত বাঁচানাে যাবে বেচারীকে । সেই থেকে নিচু জাতের শকপাল পদবী ত্যাগ করে ভীমরাও হলেন ভীমরাও আম্বেদকার । 

       মেধাবী ছেলে । এলফিনস্টোন কলেজ থেকে ভালাে নম্বর নিয়ে বি এ পরীক্ষায় পাশ করলেন । বরােদার রাজা এই ছেলেটির মেধার পরিচয় পেয়ে তাকে ডেকে চাকরি দিলেন এবং সেইসঙ্গে আরাে পড়ার জন্যে তাকে আমেরিকা পাঠালেন । আমেরিকা ও লন্ডনে অর্থনীতি ও রাজনীতি নিয়ে পড়াশােনার পাঠ শেষ করে ভীমরাও ভারতে ফিরে এলেন এবং বরােদার রাজার রাজনৈতিক উপদেষ্টা হিসাবে কাজে যোেগ দিলেন । কিন্তু দয়ালু রাজা তখন বুঝতে পারেন নি কি ভুল তিনি করে বসেছেন । এত বড়াে উচুপদে যাকে তিনি বসিয়েছেন সে যে একজন মাহার , ছােটো জাত । তাই ভীমরাও - এর অধীনে থেকে তাঁর হুকুমমতাে কাজ করতে কোনাে কর্মচারীই রাজি হল না ।

       ভীমরাও বুঝলেন কুসংস্কারাচ্ছন্ন এই সমাজের ভিতেই ধরেছে পচন । তাকে সারিয়ে তােলা আগে দরকার । তিনি শুরু করলেন আন্দোলন বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে । গান্ধীজি অস্পৃশ্যদের নাম দিয়েছিলেন হরিজন । আম্বেদকর এই নামের তীব্র বিরােধিতা করেন । তিনি বলেন অস্পৃশ্যরা যদি হরিজন বা দেবতার লােক হয় , অন্যরা কি হবে দৈত্যের লােক ? তার মতে এভাবে ‘ হরিজন ’ নাম দিয়ে আলাদা করে দেখান অস্পৃশ্যদের পক্ষে অপমানকর । কিন্তু ভারত সরকার তার যুক্তিতে কর্ণপাত করল না । হরিজন নামটিই চালু থাকলাে । 

      আম্বেদকর দেখলেন তার বা তার শ্রেণির কোনাে কথার কোনাে গুরুত্বই সরকার দেয় না উচ্চবর্গের মানুষের সরকার । এরপর ভারত স্বাধীন হতে ( ১৯৪৭ সাল ) প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু সংবিধান রচনার জন্য তাঁকে আহ্বান জানালেন । সংবিধান রচনাকারী পণ্ডিতদলের তিনি হলেন চেয়ারম্যান । প্রায় দুবছর ধরে লেখা হল ভারতীয় সংবিধান । চালু করা হল ২৬ নভেম্বর ১৯৪৯ থেকে ।

      আম্বেদকর স্বাধীন দেশের আইনমন্ত্রী হিসেবে হিন্দু আইনের ও বেশ কিছু সংশােধন আনলেন । কিন্তু অন্যেরা তার কথা মানতেই চাইল না । তাঁর আনা হিন্দু আইনের বিল পাশ না করে আটকে দেওয়া হল । প্রচণ্ড অপমানিত হয়ে ড : আম্বেদকর পরিত্যাগ করলেন আইনমন্ত্রীর পদ । 

     এতভাবে লাঞ্ছিত ও উপেক্ষিত হতে হতে তিনি বুঝতে পারলেন দেশ স্বাধীন হােক আর পরাধীনই থাকুক তার মতাে অস্পৃশ্য দলিতদের অবস্থা যে তিমিরে সেই তিমিরেই । কিন্তু হতাশায় হাল ছেড়ে দিয়ে চুপ করে বসে রইলেন না । তিনি প্রতিবাদের ভাষা খুঁজতে লাগলেন । শেষে ১৯৫৬ সালের ১৪ অক্টোবর অনুগামীদের নিয়ে ভীমরাও আম্বেদকর হিন্দুধর্ম ত্যাগ করে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করলেন । 

      সারা জীবনের সঞ্চিত ক্ষোভ আর গ্লানি এতদিনে তাঁর দূর হল । বৌদ্ধধর্মের ক্ষমা আর প্রেমের মন্ত্রে জুড়িয়ে গেল দীর্ঘ অপমানের দগদগে ক্ষতস্থান । পরম শান্তি নেমে এলাে তার জীবনে ।

       ১৯৫৬ সাল   ডিসেম্বর গভীর রাত্রে ঘুমের মধ্যে অমৃতলােকে যাত্রা করলেন তিনি । দীর্ঘ অসম যুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত , ঈশ্বরের এই দলিত সন্তানের মুখে তখন পরম প্রশান্তির ছায়া । 

      Age , caste , position , opinion - none of these is a bar an entering the chambers of the self .

সমাপ্ত 

মেঘনাদ সাহা এর সফলতার কাহিনী | Best powerful motivational success story | Bangla success story

মেঘনাদ সাহা এর সফলতার কাহিনী | Best powerful motivational  success story | Bangla success story

 মেঘনাদ সাহা  

      ভারতবর্ষে আজ পর্যন্ত যতােজন বিজ্ঞানী আন্তর্জাতিক মাপের পদার্পণ করেছেন তাদের কাউকেই মেঘনাদ সাহার মতো কষ্ট করতে হয়নি । সমাজের একেবারে নিচুতলায় , দারিদ্র্য অশিক্ষা আর ছুঁতমার্গের  অভিশাপ যেখানে তিল তিল করে শেষ করে ফেলে মানুষের সমস্ত রকম সম্ভাবনাকে সেই একেবারে ধুলাে কাদার বুক থেকেই উঠে এসেছিলেন মেঘনাদ সাহা বিজ্ঞান ভারতীর সােনার সিংহাসনে । আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু , ড : সি ভি রমণ , সত্যেন্দ্রনাথ বসুর সঙ্গেই মেঘনাদ সাহার নামও সমান সম্মান ও বিস্ময়ের সঙ্গে স্মরণীয় । কিন্তু অন্যদের তুলনায় মেঘনাদ সাহার কৃতিত্ব অনেক বেশি এইজন্যই যে তিনি উঠে এসেছেন সমাজের এক অবিশ্বাস্য অন্ধকার স্তর থেকে অবিশ্বাস্য সাফল্যের আলােয় । জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে নানারকম বাধার মােকাবিলা করতে করতে একসময় শিখরে এসে পৌঁছেন এই বিজ্ঞান সাধক । সবদেশে সবকালের পিছিয়ে পড়া দলিত মানবশ্রেণীর সামনে এক চিরউজ্জ্বল প্রেরণার ধ্রুবতারা তিনি ।

       মেঘনাদের বাবা ছিলেন এক গরিব মুদি । পাঁচটি ভাই আর বাবা মা সহ সাত আটজনের সংসার । আয়ের উৎস একমাত্র ঐ মুদির দোকানটুকু । মেঘনাদ যখন গাঁয়ের স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করলেন তখনই তার বাবা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন আর লেখাপড়া শিখে কি হবে ! এবার থেকে ও মুদির দোকানেই বসুক বড়াে ভাই - এর মতাে । 

       একে জাতিতে নীচু তায় গরিব । বেশি লেখাপড়া , ভালাে চাকরি বাকরি এসব কি আর আমাদের জন্য ? কিন্তু হাল ছাড়লেন না মেঘনাদ । শুকনাে মুখে , একবুক স্বপ্ন লুকিয়ে রেখে দোকানে বসে চাল ডাল তেল নুন ওজন করেন আর মনে মনে ভাবেন কি করে আবার শুরু করা যায় । 

     করলেনও । দাদার হাত ধরে দশ কিলােমিটার দূরের একটি অবৈতনিক স্কুলে ভর্তি হয়ে গেলেন । এখানে মাইনে দিতে হবে না তবে প্রতিদিন দশ দশ কুড়ি মাইল হেঁটে স্কুলে যাওয়া আসা করতে হবে । কিন্তু এ কষ্ট তাে কিছুই নয় । মেঘনাদ মহানন্দে আবার স্কুলে যাওয়া শুরু করলেন । কিন্তু স্কুল যেতে আসতেই এতাে সময় চলে গেলে আর পড়বেন কখন । একদিন সে সমস্যারও এক আশ্চর্য সমাধান করে ফেললেন মেঘনাদের দাদা । স্কুলের কাছেই থাকেন একজন ডাক্তারবাবু । দরিদ্র মেধাবী ছেলেটির খাওয়া পরা আর স্কুলের সব খরচ দিতে হাসিমুখে রাজি হয়ে গেলেন তিনি । 

     হতাশ জীবনে আবার ফিরে এলাে আশার আনন্দ । বইপত্র নিয়ে মেঘনাদ এসে আশ্রয় নিলেন ডাক্তারবাবুর বাড়ি । সকালবেলা উঠে বাড়ির সবার এঁটো বাসনপত্র ধুয়ে দেন । ঘরদোর পরিষ্কার করেন । গরুর জাব কাটেন । তারপর নিজের পড়াশােনা করে স্কুলে যান । পরের আশ্রয়ে থেকে চাকরবাকরের কাজ করেও তিনি লেখাপড়া চালিয়ে গেলেন । এমনি দৃঢ়তা ছিল তার মনে । 

     কোনাে কাজই ছােটো নয় । দেখতে হবে ছােটো কাজ করার ফলে । বড় কোনাে উদ্দেশ্য সফল হচ্ছে কিনা । তাছাড়া যে কোনাে কাজ করার সময় যদি কাজ করছি না ভেবে সেবা করছি বলে ভাবা যায় তবে কাজটি বড়াে আনন্দের হয়ে ওঠে । কথায় বলে কমই ধর্ম ।

      মেঘনাদ সাহার জীবনেও কমই ছিল ধর্ম । সাধনার মতাে করেই পড়াশােনা করলেন তিনি । ফলে স্কলারশিপ নিয়ে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন । পড়তে এলেন কোলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে । কিন্তু এবার পড়ার খরচের কি হবে ! চিন্তায় আকাশ ভেঙে পড়ল মাথায় । হাজার টেনে কষে ও প্রায় ১৫/২০ টাকা মাসে খরচ । এবারও এগিয়ে এলেন সেই দাদা । তিনি মাসে পেতেন ২০ টি টাকা মাইনে তাই থেকে ভাইকে পাঠাতেন ৫ টি করে টাকা । স্কলারশিপের ৪ টাকা আর বৈশ্যসমিতির অনুদান ২ টাকা । এইভাবে যােগাড় হল ১১ টাকা । বাকিটা নিজের অবসরে ছেলে পড়িয়ে যােগাড় করে নিলেন । আবার শুরু হয়ে গেল সংগ্রাম । 

       শুধু কি দারিদ্র্য ? জাতপাতের বাধা ? বামুন কায়েতের ছেলেরা সুযােগ পেলেই অপমান করে , টিটকিরি দেয় । ছােটো জাত বলে কলেজের সরস্বতী পুজোয় অঞ্জলি দিতে দেয়া হয় না । সেদিনের শিক্ষিত সমাজও এতােটাই জাতপাত নিয়ে মাথা ঘামাতাে যে সারাজীবন এই মহান বিজ্ঞানীকে অনেক অবজ্ঞা , অনেক অন্যায় আর অবহেলা সহ্য করতে হয়েছে মুখ বুজে । তবু নিজের কাজ থেকে একচুল সরে আসেননি তিনি । অলৌকিক মেধার সঙ্গে অসাধারণ পরিশ্রম জুড়ে দিয়ে তিনি বিশ্বের বিজ্ঞান সাধনাকে এগিয়ে নিয়ে গেলেন অনেক দূর । জ্যোতিঃপদার্থবিদ্যা বা এ্যাস্ট্রোফিজিক্স নিয়ে গবেষণা করে তিনি যেসব থিওরি আবিষ্কার করলেন পরবর্তীকালে সবকটি অগ্রগতিই গড়ে উঠল তার ওপর ভিত্তি করে । 

      শুধু কাগজে কলমে গবেষণা নয় বিজ্ঞান সাধনাকে ছড়িয়ে দিতে হবে দিকে দিকে মানবসেবায় । দেশে ভালাে গবেষণাগার নেই , নিজেই ভার নিলেন গড়ে তােলার । ন্যাশনাল এ্যাকাডেমি অব সায়েন্স , ইন্ডিয়ান ফিজিক্যাল সােসাইটি , ন্যাশনাল সায়েন্স এ্যাকাডেমি , ইন্ডিয়ান নিউজ এ্যাসােসিয়েশন— এসব প্রতিষ্ঠান নিজের হাতে গড়ে তুললেন কর্মযােগী মেঘনাদ । 

     দেশ যখন স্বাধীন হল , কতাে স্বপ্ন তার , কতাে আশা । বিজ্ঞানকে হাতিয়ার করে দেশের মানুষের দারিদ্র দূর করবেন । দূর করবেন কুসংস্কার আর জাতপাতের বাধা । পরমাণু শক্তির দ্বারা বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা তারই মাথায় এলাে প্রথম । অথচ নেহেরু সরকারের নেতৃত্বে যখন এ্যাটমিক এনার্জি কমিশন তৈরি হল— তখন সর্বাগ্রে বাদ পড়লেন তিনি । মেঘনাদ পেলেন এমন একটি দপ্তর যেখানে তার প্রতিভা ও আগ্রহ কোনাে কাজেই লাগবে না ।

       না , এবারেও মেনে নিলেন না মেঘনাদ । আবার হাল ছেড়ে দিয়ে রাজনীতির জটিল আবর্ত থেকে বেরিয়ে এসে শুধু বিজ্ঞানসাধনার মধ্যেই মগ্ন থেকে জীবনের সার্থকতা খুঁজে নিলেন না । তার কারণ তিনি নিজে তাে দেখেছেন এদেশের দরিদ্র , মূর্খ , দলিত মানুষেরা কী অসহনীয় জীবনযাপন করেন । মানুষের জন্য কাজ করতেই হবে— কর্মই ছিল তার একমাত্র ধর্ম । 

      ভারতের প্রথম লােকসভা নির্বাচনে নির্দল প্রার্থী হয়ে ভােটে দাঁড়ালেন এবং জিতলেনও বিপুল ভােটে । এবার কোমর বেঁধে নেমে পড়লেন কাজে । তিনি বললেন শুধু ভালাে ভালাে কিছু কথা দিয়ে দেশের উন্নতি হবে না । হতে হলে বিজ্ঞানকে কাজে লাগাতেই হবে । সেকেলে ধ্যানধারণা ছুঁড়ে ফেলে ধরতে হবে বিজ্ঞানের হাত । 

      কিন্তু কথায় বলে না গেঁয়ােযােগী ভিখ পায় না । এতাে বড়াে একজন জ্ঞানতপস্বী ও কর্মযােগীকে দেশ চেনেনি । যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে এগিয়ে আসে নি তাঁর স্বপ্ন রূপায়ণে । কিন্তু তবুও অভিমানে কিংবা হতাশায় হাল ছাড়েন নি তিনি । নিজের সাধনার পথে একনিষ্ঠ ভাবে এগিয়ে গিয়েছেন । তাই বিশ্বের বিজ্ঞানীমহলে মেঘনাদ সাহা নামের এই ব্রাত্য বাঙালি বিজ্ঞানীর নাম জ্বলজ্বল করছে সােনার অক্ষরে । 

        A smooth sea never made a skilled mariner .

রামদুলাল দে এর সফলতার কাহিনী | Bengali success story by Ramdulal Dey | Best powerfull bengali motivational success story

রামদুলাল দে এর সফলতার কাহিনী | Bengali success story by Ramdulal Dey | Best powerfull bengali motivational success story

 রামদুলাল দে  

   স্বাধীন ভারতবর্ষের অন্যতম সফল ব্যবসায়ী ছিলেন এই বাঙালি রামদুলাল দে । 

     পিতৃমাতৃহীন বালক রামদুলাল শৈশবেই চলে আসেন মামার বাড়ি । দাদামশাই বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা করেন আর দিদিমা রান্না করেন লােকের বাড়ি । 

     সারাদিনের শেষে বাড়ি ফিরে দাদামশাইয়ের আনা পাঁচমিশেলি ভিক্ষে করা চাল ফুটিয়ে দিতেন দিদিমা । তাই মনে হতাে যেন অমৃত । এভাবেই শুরু হয়েছিল যার জীবন , যৌবনে তিনি পরিচিত হয়েছিলেন বাংলার রথচাইল্ড ( একজন শীর্ষস্থানীয় ধনী ইংরেজ ) নামে ।

       দৃঢ় প্রতিজ্ঞা , সততা , নিষ্ঠা আর বিনয়- এই চারটি চারিত্রিক গুণকে মাত্র সম্বল করে উনবিংশ শতকের রামদুলাল দে এই অসাধ্য সাধন করেছিলেন । 

    না লেখাপড়া শেখার কোনাে সুযােগ তিনি পাননি । ইংরেজি অক্ষর লিখতে পারতেন না । কিন্তু স্বশিক্ষিত রামদুলালের ইংরেজি বলতে বা শুনে বুঝতে কোনাে অসুবিধা হত না । তাই চীন , জাপান , ইংল্যান্ড , আমেরিকা সহ প্রায় সারা পৃথিবী জুড়েই ছড়িয়ে পড়েছিল তার কোম্পানির ব্যবসাবাণিজ্য । বাঙালি তথা ভারতবাসী তাকে আজ বেমালুম ভুলে গেছে কিন্তু আমেরিকা ভােলেনি । সেখানকার ‘ রামদুলাল সােসাইটি ’ তার প্রমাণ ।

      কিভাবে এমন যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটাতে পেরেছিলেন জীবনে রামদুলাল দে ? সে যেন এক আশ্চর্য রূপকথার গল্প । যে কোনাে হাড় কাপানাে ইংরেজি থ্রিলারের চেয়ে কিছু কম রােমাঞ্চকর নয় । 

      রামদুলালের দিদিমা যার বাড়িতে রান্নার কাজ করতেন তিনি হলেন মদন মােহন দত্ত কলকাতার একজন মাঝারি মাপের ব্যবসায়ী । কলকাতা বন্দরে আসা জাহাজ ভর্তি মাল নিলামে কিনে তা বিক্রি করে মােটা টাকা মুনাফা করত তার কোম্পানি । এই মদনমােহন দত্তের আউট হাউসে রামদুলাল থাকতেন তার রাঁধুনী দিদিমার সঙ্গে । 

     ধনীর আশ্রিত বালক । তাকে খরচপত্র দিয়ে পাঠশালায় পড়তে পাঠানাের প্রশ্নই ওঠে না । দিদিমা কাজে বেরিয়ে যাবার পর বালক রামদুলাল পায়ে পায়ে চলে যেতেন পাড়ার পাঠশালার কাছে । চুপ করে বসে থাকতেন আটচালার বাইরে , পথের ধারে । ছাত্ররা কলাপাতার ওপর কঞ্চির কলম দিয়ে লেখা অভ্যাস করত । তারপর ছুটির সময় লেখা কলাপাতাগুলাে ফেলে দিত বাইরে ছুঁড়ে । রামদুলাল সেগুলি সযত্নে কুড়িয়ে রেখে দিতেন । অস্পষ্ট হয়ে যাওয়া লেখাগুলির ওপর বুলিয়ে বুলিয়ে অভ্যাস করতেন নিজে নিজে । তারপর পাতাগুলি জলে ধুয়ে এনে নিজের হাতে আবার নতুন করে লিখতেন । মিলিয়ে নিতেন অন্য লেখার সঙ্গে ঠিক হলাে কিনা । 

     এভাবেই চলছিল অক্ষর জ্ঞান । ধনী বালকের ছেড়া পরিত্যক্ত বইখাতা দেখে দেখে পড়তেও শিখলেন বাংলা । তার মেধার পরিচয় পেয়ে এবং বিনয়ী নম্র ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে বাড়ির মালিক মদনমােহন দত্ত তাকে পাঁচ টাকা মাইনের বিল সরকারের চাকরি দিলেন । কিন্তু ভিক্ষান্নে পালিত রামদুলালের মনের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ওই পাঁচ টাকা ( এখনকার হিসেবে প্রায় ৭০০০ টাকা ) মাইনেতেই এসে থামতে পারল না। একদিন রামদুলাল তার প্রভুর বিনা অনুমতিতে প্রভুর ১৪,০০০ টাকা খাটিয়ে এক ডুবােজাহাজ নিলামে ডেকে নিলেন । কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ওই জাহাজের সব মাল বিক্রি হয়ে গেল এক লাখ চোদ্দ হাজারে । লাভের এই এক লাখ টাকা রামদুলাল নিঃশব্দে আত্মসাৎ করে নিতে পারতেন । কিন্তু করলেন না । সবিনয়ে পুরাে টাকাটাই তুলে দিলেন মনিবের হাতে । 

       এই বিশ্বাসের সম্মান দিলেন মদনমােহন দত্ত । তিনি ওই এক লাখ টাকা ( বর্তমানে ১৪,০০০০০০ - এককোটি চল্লিশ লাখ ) রামদুলালকে দিয়ে তাকে নিজের স্বাধীন ব্যবসা করতে বললেন । সেই শুরু তারপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি রামদুলালকে । কোটি কোটি টাকা উপার্জন করেছেন জীবনে । কিন্তু নিজের ভিক্ষান্ন । লালিত শৈশবের কথা একটিবারের জন্যও ভােলেন নি তিনি । তাই সারাজীবন সাদাসিধে অসাড়ম্বর জীবনযাপন করে গেছেন আর দুই হাতে করে গেছেন দান ধ্যান । দারিদ্র্যের যন্ত্রণা যে কি তিনি জানতেন । জানতেন অনাহারের কষ্ট । 

     তাই প্রতিমাসে চারশাে দরিদ্র প্রতিবাসীকে তিনি চাল , ডাল ও বাজার খরচের জন্য টাকা দিতেন । প্রতিদিন তার অফিসে দলে দলে লােক আসত সাহায্য প্রার্থনা করতে । তাদের জন্য দৈনিক সত্তর টাকা বরাদ্দ ছিল । কর্মচারীদের অবসরের পর পেনশানের ব্যবস্থা তিনিই প্রথম প্রচলন করেন । এছাড়া তিনজন পাশ করা ডাক্তার নিযুক্ত করা ছিল । তারা কর্মচারীদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে ঘুরে তাদের চিকিৎসা করতেন ও ওষুধ পথ্য সরবরাহ করতেন ।

      বিশাল অতিথিশালা সেখানে জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে এক হাজার অতিথি প্রতিদিন পেটপুরে খেতে পায় । এমনকি মৃত্যুর সময়েও রামদুলাল দু লাখ টাকা আলাদা করে রেখে যান , দরিদ্র অতিথি সেবার জন্য । রামদুলালের জীবনসংগ্রামের পিছনে সম্ভবত একটাই উদ্দেশ্য দৃঢ়ভাবে কাজ করেছিল তা হল দরিদ্রদের সাহায্য করা । হাজার হাজার বেকারকে চাকরি দিয়ে , লক্ষ লক্ষ দরিদ্রের মুখে অন্ন দিয়ে তিনি জীবনকে সর্বার্থেই সার্থক ও সফল করে তুলেছিলেন । তাই তার সংগ্রাম ও সফলতা আজ কিংবদন্তী । 

      To accomplish great things we must dream visualize , plan , believe and act .

আমাদের আর ও মহিয়সীদের সফলতার কাহিনী :-

ঝুলন গোস্বামী এর সফলতার কাহিনী | Jhulan gosshami success story in bengali | Bangla motivational success story

ঝুলন গোস্বামী এর সফলতার কাহিনী | Jhulan gosshami success story in bengali | Bangla motivational success story

 ঝুলন গােস্বামী 

        বাঙালি মেয়েরা শান্তশিষ্ট ঘরােয়া আর অসাধারণ সহিষ্ণু এই হিসেবেই পৃথিবীতে পরিচিতি তাদের । কিন্তু তারা যে খেলাধুলােতেও পিছিয়ে যায় না— সমস্ত রকম সামাজিক , অর্থনৈতিক আর পারিবারিক বাধা ডিঙিয়ে উঠে আসতে পারে আন্তর্জাতিক আঙিনায়— সব্বাইকে হারিয়ে দিয়ে কেড়ে নিতে পারে শ্রেষ্ঠত্বের শিরােপা ঝুলন গােস্বামী তার উজ্জ্বল উদাহরণ । বিশ্বের দ্রুততম মহিলা বােলার ঝুলন বাঙালি মেয়ের ক্রিকেট খেলাকে বিশ্বের দরবারে নিয়ে গেছে । পরে এসেছে বিশ্বজয়ের মুকুট । বিশ্বকাপ মহিলা ক্রিকেটে , অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে প্রথম ম্যাচে পাকিস্তানকে ৫৭ রানে দুমড়ে মুচড়ে দিয়ে ১০ উইকেটে হারিয়ে দিলেন ক্যাপ্টেন ঝুলন গােস্বামী । চমকে উঠে ফিরে তাকালো পৃথিবী । 

         একে বাঙালি , তায় মেয়ে । বাড়ির কেউই চায়নি ঝুলন ক্রিকেট খেলাকেই জীবনের লক্ষ্য করুক । কিন্তু ৫ ফুট ১১ ইঞ্চির ঢ্যাঙা মেয়েটা ছােটো থেকেই ডানপিটে স্বভাবের । পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে টেনিস বলে ক্রিকেট খেলত । কিন্তু এতাে ধীর বল করতাে ঝুলন যে প্রতিটা বলেই ছক্কা মেরে দিতে ওরা । এমনকি ছেলেরা বিরক্ত হয়ে তাকে বল করতেই দিত না । পাঠিয়ে দিত ব্যাটিং - এ । সেই থেকেই ঝুলনের মনে প্রতিজ্ঞা দানা বাঁধল- দ্রুত বল তাকে করতেই হবে । দেখিয়ে দেবে , যে ছেলেদের চেয়ে কোনাে অংশেই কম যায় না সে । 

        মাত্র বছর ১৫ বয়স তখন মেয়েটার । কিন্তু সেই বয়সেই সে বুঝে গিয়েছিল যে স্বপ্ন শুধু দেখলেই হয় না , তার পিছনে ছুটেও যেতে হয় লাগাতার । 

       তাই বাড়ির সবাইয়ের আপত্তির কাছে মাথা নিচু না করে সে শুরু করে দিল ট্রেনিং নেওয়া । নদীয়া জেলার চাকদায় বাড়ি । সেখান থেকে কলকাতায় এসে ট্রেনিং নিয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে সামান্য বিশ্রাম নিয়ে আবার পড়তে বসা । দৈনিক ৪০ কিলােমিটার পথ ট্রেনজার্নি করার পর শরীর ভেঙে পড়তে চাইত । কিন্তু ভেঙে পড়েন নি ঝুলন । হাল ছেড়ে দেন নি । বাড়িতে যাতে অশান্তি না হয় সেজন্য খেলার সাথে সাথে পড়াশােনাও ঝুলন চালিয়ে গেছেন সমান তালে । আর এই দুদিক সমানে চালাতে গিয়ে কী অমানুষিক পরিশ্রমই না করতে হয়েছে তাঁকে । ভাের সাড়ে চারটেয় ঘুম থেকে ওঠা । একটু দেরী হলেই ট্রেন ফেল হয়ে যেত । দেরী হয়ে যেত প্র্যাকটিসের হাজিরায় । শুনতে হতাে বকুনি । কিন্তু কিছুতেই দমাতে পারেনি ১৫/১৬ বছরের দামাল মেয়েটিকে । প্রতিদিন প্রায় পাঁচ ঘণ্টারও বেশি জার্নি করার পরও ক্লান্তি বিরক্তি বা হতাশাকে আমল দেননি একটি দিনের জন্য । ৮০ মাইল ট্রেন জার্নি , দীর্ঘ প্র্যাকটিসের পরিশ্রম সবকিছুর পরেও বাড়িতে ফিরেই উঠানের কুয়ে থেকে জল তুলে মুখ হাত ধুয়ে , সামান্য জলখাবার খেয়ে নিয়েই পড়তে বসে যেত আর পাঁচটা ছেলেমেয়ের মতাে । অথচ কতােই না ফারাক আর পাঁচজনের সঙ্গে ঝুলন গােস্বামী নামের মেয়েটার ।

        নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান । টালির চালের অতি সাধারণ এই বাড়িতে গ্রাম্য পরিবেশে বড়াে হয়ে ওঠা একটা মেয়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হবার স্বপ্নই তাে দেখবে না সাহস করে । 

       কিন্তু ঝুলন দেখেছিল । তার অদম্য জেদ আর সবকিছুকে ফেস করতে রাত্রী থাকার মানসিকতার কাছে একটা সময় হার মানতে হয়েছে সবাইকে । সামান্য লেখাপড়া , তারপর বিয়ে আর ঘরসংসার এই ছকে বাঁধা জীবনের বাইরে বেরিয়ে এসে সাধারণ ঘরের মেয়ে ঝুলন অসাধ্য সাধন করেছে ।

      ট্রেনিং পিরিয়ড তাে শেষ হল । ঝুলনের পারফরম্যান্সও যথেষ্ট আশাব্যঞ্জক । কিন্তু দেশবিদেশে খেলতে যাবার জন্যে দরকার অর্থের । একথা মনে করিয়ে দিয়ে ঝুলনের বাবা মা বােঝালেন যতােদূর হয়েছে ওখানেই থাক । এর বেশি উঁচুতে ওঠা আর সম্ভব নয় । দেশের মাটিতেই থাকো সন্তুষ্ট হয়ে । ঝুলন বুঝলেন সমস্যার বাস্তবতা , কিন্তু হাল ছাড়লেন না ।

        ১৯৯৭ সালে কোলকাতার মাঠে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের মধ্যে মহিলাদের ক্রিকেট টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হল । ঝুলন দুচোখ ভরে দেখল সেই খেলা আর দেখতে দেখতে তার মনপ্রাণ উদ্দীপিত হয়ে উঠল এক অভিনব দৃঢ় প্রতিজ্ঞায়— না , যেমন করেই হােক ক্রিকেটটা খেলে যেতেই হবে । আর শুধু দেশের মাটিতেই সীমাবদ্ধ হয়ে থাকলে চলবে না , খেলতে হবে বিদেশের মাটিতেও । হারাতে হবে ওই বিদেশিনীদের । কি এমন খেলে ওরা ! ঝুলনের যথেষ্ট ক্ষমতা আছে ওদের পাল্লা নেবার । 

        কিন্তু কোথাও থেকে বড়াে সুযােগ আসছে না কোনাে । কিন্তু তাই বলে হাল ছেড়ে দিল না ঝুলন । নিয়মিত প্র্যাকটিস চালিয়ে যেতে লাগল প্রতিদিন । শীত গ্রীষ্ম বর্ষা— বারােমাস একটি দিনের জন্য গ্র্যাকটিস বন্ধ থাকত না তার । এর মধ্যে ঘরােয়া ক্রিকেটে ঝুলন গােস্বামী ততােদিনে হয়ে উঠেছে একটি অতি পরিচিত নাম । 

       বছর তিনেক অপেক্ষা করার পর হঠাৎ এসে গেল একটা সুযােগ । সেটা ২০০০ সালের কথা । ইস্টজোন ও এয়ার ইন্ডিয়ার মধ্যে খেলা ছিল । ঝুলন খেলছিল ইস্টজোনে । এয়ার ইন্ডিয়ার পক্ষে অঞ্জু জৈন সহ আরাে অনেক বাঘা বাঘা খেলােয়াড় । সেদিন বােধহয় স্বয়ং ঝড়ের দেবতা পবনদেব ভর করেছিল ঝুলনের বলে । মােট তেরাে ওভারে সে এয়ার ইন্ডিয়ার মতাে বলিষ্ঠ দলকে নিতে দিয়েছিল সাকুল্যে ১৩ রান  এবং নিজের ঝুলিতে ভরে নিয়েছিল তিন তিনটি উইকেট । কর্তাব্যক্তিরা আর মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারলেন না । চোখের দৃষ্টি তাদের কেড়ে নিল ঝুলন । বহু উপেক্ষিত মহিলা ক্রিকেটার ঝুলন গােস্বামী । 

       এমনিতেই আমাদের দেশটা খেলাধুলােকে খুব একটা গুরুত্ব বা মর্যাদা দেয় না । আজও এদেশের ছেলেমেয়েরা খেলােয়াড় হিসেবে ভবিষ্যৎ গড়ার স্বপ্ন দেখলে বাবা মা বুঝিয়ে সুঝিয়ে তাকে নিরস্ত্র করে ছাড়েন । তার কারণ একটাই , খেলে কেউ নামও করতে পারে না । টাকাও করতে পারে না- এক্কেবারে সেই প্রথম সারির দু - একজন ছাড়া । এদেশে খেলা বলতে যা কিছু মাতামাতি তা ফুটবল আর ক্রিকেট নিয়ে— তাও কেবলমাত্র পুরুষদের । মহিলাদের নয় । পত্রপত্রিকাগুলাে পাতার পর পাতা , নামী দামী খেলােয়াড়দের বিভিন্ন পােজের ছবি আর তাদের খেলা না খেলা ক্রীড়ামুহূর্তের চর্বিত চর্বন— এই নিয়েই ব্যস্ত থাকে । ঝুলনদের মতাে খেলােয়াড়দের জন্য এক তিল জায়গা বরাদ্দ করে না তারা । নিতান্ত বড়াে কোনাে জয়ের পর ১০/১২ লাইনের ছােট্ট একটি স্তম্ভে দায়সারা একটি খবর । সঙ্গে না ছবি— না কিছু , না বিশেষজ্ঞ কোনাে প্রবীণ ক্রিকেটারের মতামত । মেয়ে ক্রিকেটার যেন বিমাতার সন্তান । একই খেলা , একই সংগ্রাম , একই মর্যাদাপূর্ণ জয়— তবু পুরুষ ক্রিকেটার ও মহিলা ক্রিকেটারের মধ্যে এই আকাশপাতাল ফারাক এক একসময় বিরক্ত আর হতাশ করে তােলে ঝুলনকে চরম ভাবে । কিন্তু তাতেও কখনােই হাল ছাড়েন না তিনি । 

        যাই হােক , সেবার ইষ্টজোনের হয়ে সেই দুর্ধর্ষ খেলায় কর্তৃপক্ষের চোখে পড়ে গেছেন ঝুলন । তারই ফলশ্রুতি স্বরূপ ২০০২ সালে ইংল্যান্ড যাত্রার সুযােগ পেয়ে গেলেন । পরবর্তীকালে অস্ট্রেলিয়া সফর এবং ২০০৫ - এ বিশ্বকাপ খেলার সুযােগও পেয়েছেন ঝুলন । সেই ২০০২ থেকে শুরু করে ক্রমাগত এগিয়ে চলেছেন ঝুলন । ভারতের হয়ে বিদেশের মাটিতে খেলতে নেমে চাকদার এক অজ্ঞাত পল্লীর এই দুর্দান্ত জেদী একরােখা মেয়েটি বারবার তার প্রতিপক্ষকে বুঝিয়ে দিয়েছে কতােখানি শক্তি ধরে এই দীর্ঘাঙ্গিনী বঙ্গকন্যার বাহু । বর্তমান বিশ্বের এই দ্রুততম মহিলা বােলারকে মুম্বই - এর ক্রিকেট এ্যাকাডেমি সম্প্রতি ক্যাসটুল পুরস্কারে ভূষিত করেছে । ঝুলন গােস্বামীর দুঃসাহসী সাধনা পৌছে গেছে । সাফল্যের উপকূলে । মাত্র ২২ বছর বয়স তার । এরই মধ্যে বাহুতে ঝড়ের গতি । ঘণ্টায় ১২০ কিমি বেগ তার বলের যার সামনে তাসের ঘরের মতাে ভেঙে পড়ে বিপক্ষের উইকেট একের পর এক । না , তার জন্য কোনাে নামীদামী বিদেশি কোচ রাখা হয়নি ঠিকই কিন্তু প্রতিবার ভারতের হয়ে বিদেশের মাটিতে পা রাখার আগে ঝুলন ছুটে গেছেন । চেন্নায়ের M. R. F পেস একাডেমিতে । ডেনিস লিলি ( অস্ট্রেলিয়ার কিংবদন্তী বােলার ) র সঙ্গে দেখা করে তার থেকে নিয়েছেন উপদেশ ও প্রয়ােজনীয় টিপস । নিরন্তর সাধনা ও প্রবীণের পরামর্শ— এই টুকুমাত্র সম্বল করে ঝুলন ক্রমাগত এগিয়ে চলেছেন । ২০০৯ সালের মার্চে , অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে দাঁড়িয়ে দু দুটি ম্যাচে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে দিয়ে । ঝুলন প্রমাণ করেছেন বাঙলার এক সামান্য মেয়ে হয়েও তিনি কতােখানি অসামান্য । দারিদ্র , উপেক্ষা , বঞ্চনা— সবকিছুকে বুড়াে আঙুল দেখিয়ে স্থির লক্ষ্যের পথে দৃঢ় মুষ্টিবদ্ধ ঝুলন গােস্বামী এগিয়ে চলেছেন ।

        " মেঘ দেখে কেউ করিস নে ভয় আড়ালে তার সূর্য হাসে । হারা শশীর হারা হাসি অন্ধকারেই ফিরে আসে ।"

                                - রবীন্দ্রনাথ