শ্রুতি মেনন
মেয়েটির নাম শ্রুতি । শ্রুতি মেনন । ব্যাঙ্গালােরে একটি সাজানাে গােছানাে ছিমছাম ফ্ল্যাটে নিজের বাবা মায়ের সঙ্গে থাকত শ্রুতি । মাত্র ১৫/১৬ বয়স তার । কাছেই একটা নামী স্কুলে পড়ে শ্রুতি । পড়াশােনাতেও সে বেশ ভালাে । বাবা মা আর স্কুলের শিক্ষিকাদের চোখে একরাশ স্বপ্ন শ্রুতিকে ঘিরে । স্কুলের ফাইনাল পরীক্ষায় নিশ্চয় খুব ভালাে ফল করবে সে স্বপ্ন দেখে শ্রুতি ।
কিন্তু সহসা কোথা থেকে যেন ছুটে আসা এক উদ্দাম ঝােড়াে হাওয়া জীবনটাকে তার তছনছ করে দিল মুহূর্তে ।
পাড়ার ছেলে রাজেশ । স্কুলে আসা যাওয়ার পথের ধারে প্রায় প্রতিদিনই দাঁড়িয়ে থাকত সে । প্রথম প্রথম শ্রুতি দেখেও না দেখার ভান করে এড়িয়ে যেতাে । কিন্তু ক্রমে ক্রমে ব্যাপারটা বেশ সিরিয়াস হয়ে দাঁড়াল ।
রাজেশ মস্তান টাইপের ছেলে । সে শ্রুতিকে প্রথম প্রথম নানারকম তােষামুদে কথাবার্তা বলে বাগে আনবার চেষ্টা করত । কিন্তু শ্রুতি একেবারেই পাত্তা দিচ্ছে না দেখে রাজেশের জেদ ক্রমশ বেড়ে যেতে লাগল । সে প্রতিদিন শ্রুতিকে শাসাতে লাগল এই বলে যে যদি তার কথা শ্রুতি না শােনে তবে তাকে সে চরম শাস্তি দেবে ।
শ্রুতি শক্ত চরিত্রের মেয়ে । মেয়েমানুষ হলেও সে বুঝতে পেরেছিল এ ধরনের সমাজবিরােধী ছেলেদের সংস্রব কতােখানি বিপজ্জনক । তাই সে সাবধানে রাজেশকে এড়িয়ে চলত । এমনকি স্কুল যাবার একটা বিকল্প পথও সে বার করে নিল ।
কিন্তু রাজেশ এতাে সহজে ছাড়বার পাত্র নয় । পরদিন বিকল্প এই পথের পাশেই যথাসময়ে তাকে দেখা গেল । এবার সে সরাসরি এসে দাঁড়াল স্কুলের পােশাক পরা বালিকাটির সামনে ।
—আমি জানতে চাই , তুমি আমাকে বিয়ে করবে কিনা ! আচমকা এরকম ঘটনায় হকচকিয়ে গেল শ্রুতি । কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে কঠোর ও ঠাণ্ডা গলায় উত্তর দিল সে ,
—প্রাণ থাকতেও নয় ।
—তার কারণ ?
—কারণ তােমাকে আমি ঘৃণা করি ।
–বেশ , এর প্রতিফল তােমাকে পেতে হবে ।
কথাটা শুনেও তেমন গুরুত্ব দিল না শ্রুতি । মাস্তানি মার্কা হাল্কা শাসানি ভেবে উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করল ।
পরদিন স্কুলের পােশাক পরে দ্রুত পায়ে এগিয়ে চলেছে শ্রুতি । হঠাৎ পথের ধারে ঝােপের পিছন থেকে সাঁ করে ছুটে এলাে একটা অ্যাসিড বাল্ব তার মুখ লক্ষ করে । মুহূর্তে কী ঘটে গেল ! অসহ্য যন্ত্রণায় তীব্র আর্তনাদ করতে করতে দু হাতে মুখ ঢেকে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল শ্রুতি এবং জ্ঞান হারাল তৎক্ষণাৎ |
কয়েকদিন পর হাসপাতালে জ্ঞান ফেরবার পর শ্রুতি জানতে পারল অ্যাসিডে পুড়ে চিরদিনের মতাে নষ্ট হয়ে গিয়েছে তার চোখ আর কান । চিরদিনের মতাে অন্ধ আর বধির হয়ে গিয়েছে সে । সমস্ত মুখ , বুক আর মাথায় অসহ্য দাহ । চামড়া পুড়ে পুড়ে একটু একটু করে কুঁচকে যাচ্ছে আর সমস্ত উর্ধাঙ্গ ধারণ করছে এক বীভৎস রূপ । সে অসহ্য যন্ত্রণা সহ্যের সমস্ত সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে । প্রতিটি মুহূর্তে মনে হচ্ছে এ নরক যন্ত্রণা সহ্য করে বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যু অনেক ভালাে ।
কিন্তু না , শেষপর্যন্ত হাল ছাড়ল না শ্রুতি । সে ভাবল এভাবে যদি সে জীবন থেকে পালিয়ে যায় তা হলে রাকেশের মতাে গুণ্ডা বদমাইশরা আরাে বেশি প্রশ্রয় পেয়ে যাবে । তাকে জিততেই হবে । তার জিত মানেই রাকেশদের হার । তাই এই যুদ্ধটা অর্থাৎ বেঁচে ওঠার যুদ্ধটা জিততেই হবে শ্রুতিকে যেমন করেই হােক ।
কিন্তু এরকম রুগীকে সুস্থ করে তুলে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে দিতে গেলে প্রচুর প্রচুর অর্থের প্রয়ােজন । শ্রুতির বাবা একজন দর্জি । তবু একমাত্র মেয়ের চিকিৎসার জন্য তিনি নিজের সমস্ত সঞ্চয় উজাড় করে ঢেলে দিলেন । নিতান্ত ছেলেমানুষ শ্রুতির তীব্র মনের জোর আর চারিত্রিক দৃঢ়তা দেখে সেদিন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল বেশ কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানও ।
সবার সহযােগিতা পেয়ে মনের জোর বেড়ে গেল শ্রুতির । দ্রুত সেরে উঠতে লাগল সে । যমের সঙ্গে প্রথম রাউন্ডের লড়াইয়ে বীরের মতাে বিজয়ীর হাসি হাসতে হাসতে হাসপাতাল থেকে একদিন ঘরে ফিরে এল শ্রুতি ।
কিন্তু বাড়ি ফিরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে প্রায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলার মতাে অবস্থা হল তার ঘৃণায় - আতঙ্কে - লজ্জায় । নিজের অতিপ্রিয় কিশােরী শরীরটার দিকে আর তাকাতে পারল না সে একবারও । তবে কি সারাজীবন এই বিভৎস রূপ নিয়ে গৃহবন্দী হয়ে থাকতে হবে তাকে ? না , হার মানলে চলবে না ।
কিছুতেই হার মানবে না সে । যতাে কষ্টই হােক- যতাে দিনই লাগুক ! শ্রুতির বাবা মা প্লাস্টিক সার্জেন্টের সঙ্গে কথা বললেন । ছ বছরে মােট ৩৯ বার অপারেশন করা হল তার শরীরে । ধীরে ধীরে ফিরে এলাে হারানাে রূপ । যদিও সম্পূর্ণ নয় তবু ৬ বছরের নিরলস চেষ্টায় অনেকটাই স্বাভাবিক চেহারায় ফিরে এলাে শ্রুতি ।
শরীরের জন্য পড়াশােনায় বাধা পড়েছিল বলে টেনথ স্টান্ডার্ডের পরীক্ষাটাও দেওয়া হয়ে ওঠেনি তার । এ কারণে সবসময় হীনমন্যতায় ভুগত শ্রুতি । বয়সটাও অনেকটাই বেড়ে গেছে । এখন তাে আর স্কুলে অল্পবয়সী মেয়েদের সঙ্গে পড়তে যাওয়া সম্ভব নয় ।
তবে কি মূখ হয়েই থাকবে সে আজীবন ? না , শ্রুতি কিছুতেই হার মানবে না । বাবা মা - এর সাহায্যে বইপত্র যােগাড় করে ঘরে বসেই পড়াশােনা করে পরীক্ষা দিল শ্রুতি এবং যথেষ্ট ভালাে নম্বর পেয়েই পাশ করল সে । এবার বাবাকে সাহায্য করার জন্য ঘরে বসে টেলিমার্কেটিংয়ের কাজ করে অর্থ উপার্জন করতে লাগল শ্ৰতি । নিজের স্বােপার্জিত অর্থে সংসারকে সাহায্য করছে সে , একটু একটু পরিশোধ করতে পারছে চিকিৎসার জন্য হয়ে যাওয়া বিপুল ঋণ । এই চিন্তা থেকেই হারানাে আত্মবিশ্বাস একটু একটু করে ফিরে আসতে লাগল শ্রুতির মনে । সে বুঝতে পারল সেও পাচজনের মতােই সহজ সুস্থ , স্বাভাবিক একজন দায়িত্বশীল মানুষ । সেও পারে সংসারের দায়িত্ব নিতে , বাঁচতে , বাঁচাতে ।
এখন শ্রুতি বড়াে একটি কোম্পানিতে চাকরি করে । আত্মবিশ্বাসে পরিপূর্ণ শ্রুতি সাধারণ হয়েও আজ অসাধারণ । অশুভ শক্তির সঙ্গে অসম যুদ্ধে সসম্মানে জয়ী হয়ে সে আজ সকলের আদর্শ , সমস্ত দুঃখী , দুর্গত ও উৎপীড়িত মানুষের কাছে এক উজ্জ্বল অনুপ্রেরণা ।
Real leaders are ordinary people with extraordinary determinations .
0 Comments: