রবার্ট ব্রুস
স্কটল্যান্ডের সীমান্তে গভীর এক বনের মধ্যে তখন সবেমাত্র দুপুর গড়িয়ে বিকেল নেমেছে । চারিদিকে ঘুটঘুট্টি অন্ধকার । কাছে পিঠে কোথাও হাহা করে ডেকে উঠলাে এক হিংস্র হায়না । শুকনাে ডালপালা মাড়িয়ে ছুটে এল কোনাে জানােয়ার । এক নাগাড়ে ডেকে চলেছে ঝি ঝি পােকা । তাছাড়া আর কোথাও কোনাে শব্দ নেই । দশ বারাে মাইলের মধ্যে নেই কোনাে মানুষের চিহ্ন । চারিদিকে শুধু ভীষণ অরণ্য আর নিকষ কালাে অন্ধকার । প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর আশঙ্কায় যেন কেঁপে কেঁপে উঠছে বনভূমি ।
এই নির্জন ভয়ঙ্কর বনের মধ্যে এক পাহাড়ের ছােট্ট গুহায় , ঘুটঘুটে অন্ধকারে একলাটি চুপ করে শুয়ে আছেন এক মাঝবয়সী মানুষ । শরীরে যােদ্ধার পােশাক ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে । বর্মে হয়েছে হাজারটা ছিদ্র । হাতে - পায়ে - মুখে নানা জায়গায় অজস্র আঘাতের চিহ্ন । তাদের কোনাে কোনােটা থেকে রক্ত ঝরে শুকিয়ে আছে । কোনােটা থেকে তখনও নেমে আসছে টুইয়ে পড়া ক্ষীণ রক্তধারা । ক্রমাগত রক্তপাতে মানুষটি অবসন্ন হয়ে পড়েছেন । ক্লান্ত মাথাটি বাম বাহুর ওপর রেখে চোখ বন্ধ করে পড়ে আছেন সঁাতসেঁতে মেঝের ওপর । অসম্ভব তৃষ্ণায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে । কিন্তু একদম জনমানব শূন্যস্থানে জলের আশা দূরাশা ছাড়া আর কিছুই নয় । তাই জলের সন্ধান না করে মানুষটি শুয়ে শুয়ে শান্তভাবে মৃত্যুর প্রতীক্ষা করতে লাগলেন ।
একে একে তার মনে পড়ে যেতে লাগলাে জীবনের ফেলে আসা ১৭ টি বছরের কথা । ইংল্যান্ডের রাজা এডােয়ার্ড II ষড়যন্ত্র করে রাজ্যচ্যুত করল তাকে । তারপর দিনের পর দিন , বছরের পর বছর বনে জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে সৈন্য সংগ্রহ করেছেন তিনি । তারপর অনেক আশা আর উদ্যম নিয়ে ছুটে গেছেন রাজ্যোদ্ধারে কিন্তু প্রতিবারই সকরুণ ভাবে ব্যর্থ হয়েছেন । গ্রামবাসী , কৃষক প্রজারা দয়া করে তাকে খাবার পাঠিয়ে দিয়েছে । তাই খেয়ে প্রাণ বাঁচিয়ে রেখেছেন কোনােমতে । স্ত্রী পুত্র পরিবার যে কোথায় আছে , বহুদিন তাদের কোনাে খবর পাননি । সবচেয়ে ছােটো মেয়েটির কথা ভেবে তার চোখে জল এসে যায় । তার জন্মের পর থেকেই তিনি তাদের আত্মীয়দের বাড়ি রেখে এসেছেন , না জানি কতােই না অনাদরে আর অবহেলায় তাদের দিন কাটছে , হয়তাে বা বেঁচেই নেই । হয়তাে বা অপমানের হাত থেকে বাঁচতে তারা পালিয়ে গেছে ভিন রাজ্যে । ঈশ্বর জানেন জীবনে আর কখনও দেখা হবে কিনা !
অতীতের কথা ভাবতে ভাবতে অসহ্য ক্ষুধা আর ক্লান্তিতে কখন যেন দুচোখ জুড়ে ঘুম এসে গিয়েছিল তাঁর । হঠাৎ একদিন বন্য পিপড়ের তীব্র দংশনে ঘুম ভেঙ্গে গেল ততক্ষণে হাজার হাজার পিপড়ে ঘেঁকে ধরেছে তাকে । নির্বিচারে দংশন করে চলেছে তাকে , কিন্তু শরীরে এতটুকু শক্তি নেই যে পিপড়েগুলােকে তাড়ান । তীব্র যন্ত্রণায় চোখে জল এসে গেল । এতদিন পর তার মনে হল , এভাবে বেঁচে থাকার কোনাে মানে হয় না । এভাবে বনে জঙ্গলে পালিয়ে পালিয়ে বেড়িয়ে অমানুষিক কষ্ট সহ্য করে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া ঢের ভালাে । এতদিনে যখন পারলেন না তখন স্কটল্যান্ডের সিংহাসন পুনরুদ্ধার করা তার দ্বারা আর বােধহয় ইহজীবনে সম্ভব হবে না । অথচ শত্রুর কাছে আত্মসমর্পণ করে , দেশবাসীর তীব্র বিদ্রুপ , লাঞ্ছনা আর অপমান নীরবে হজম করে ভীরু কাপুরুষের মতাে বেঁচে থাকতেও তিনি রাজী নন । অতএব আত্মহত্যা করাই বােধহয় সব যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার একমাত্র পথ ।
গভীরভাবে চিন্তা করছেন রবার্ট ব্রুস আর অন্যমনস্কভাবে তাকিয়ে আছেন গুহার দেওয়ালের দিকে । ভাঙ্গা ফাটল দিয়ে তখন গুহার মধ্যে এসে পড়েছে দিন শেষের মরা আলাে । সেই আবছা আলােয় রবার্ট ব্রুস দেখছিলেন একটি ছােট্ট মাকড়সা দেওয়ালের গায়ে জাল বােনার চেষ্টা করে চলেছে । গুহার পিচ্ছিল পাথরের দেওয়ালে জাল বুনতে গিয়ে বারবার ব্যর্থ হচ্ছিল মাকড়সাটি । বেশ কিছুটা করে জাল বােনে তারপর হঠাৎই সবটা ছিড়ে ঝুলে যায় । মাকড়সাটি একটুও না থেমে আবার শুরু করে দেয় বােনা । আবার বােনে , আবার ছেড়ে । আবার নতুন উদ্যমে শুরু হয়ে যায় বােনার কাজ , একটুও বিরতি নেই , একটুও ফাঁকি নেই তার কাজে ।
রবার্ট ব্রুস একমনে দেখতে লাগলেন । অন্যমনস্ক হলে ক্ষুধা , তৃষ্ণা আর ক্ষতের জ্বালা অন্তত কিছুটা কমবে । তিনি ক্লান্ত দৃষ্টিকে যতদূর সম্ভব প্রসারিত করে দেখতে লাগলেন মাকড়সার কাণ্ডকারখানা । দেখতে দেখতে সারা বিকেলটা পার হয়ে গেল । এর মধ্যে অন্তত একশত বার ব্যর্থ হয়েছে মাকড়সাটি , কিন্তু হাল ছাড়েনি । তার অধ্যবসায় দেখে এত দুঃখেও হাসি পেল তাঁর । ভাবলেন আমার মতােই বেচারী মিথ্যে আশার পেছনে ছুটে বেড়াচ্ছে , ওর জন্যে একটু বুঝি দুঃখও হল তাঁর ।
অন্যমনস্ক হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন , ঘুম যখন ভাঙ্গল তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে । অরণ্যের আকাশে উঠেছে বিরাট একফালি চাদ । গুহার দেওয়ালের সরু ফাটলখানা দিয়ে একমুঠো চাঁদের আলাে এসে পড়েছে । দেওয়ালে । সেই আবছা আলােয় রবার্ট ব্রুস দেখতে পেলেন গুহার দেওয়াল জোড়া বিশাল একখানি মাকড়সার জাল আর তার ঠিক মাঝখানটিতে চুপটি করে বসে আছে বিন্দুর মতাে ছােট্ট সেই মাকড়সাটি ।
অনেকক্ষণ ধরে নিপুণভাবে বােনা মাকড়সার জালটির দিকে স্থির বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন রবার্ট ব্রুস ।
তাই তাে ! অতটুকু একটা কীট , দেখাই যায় না প্রায় , তারও কত মনের জোর । সারাটা দিন ধরে কত শতবার ব্যর্থ হল তবু হাল ছাড়লাে । শেষপর্যন্ত জালটা বুনেই তবে ছাড়ল । এখন কেমন সুখী সে , কত তৃপ্ত ।
নাঃ , মরতেই যদি হয় , তবে যুদ্ধক্ষেত্রেই মরব । এভাবে কাপুরুষের মতাে অন্ধকার গুহার কোণে লুকিয়ে মরব না । শরীরের অবশিষ্ট শক্তিটুকু দিয়ে কোনােমতে উঠে দাঁড়ালেন মহাবীর রবার্ট ব্রুস । জিততেই হবে , একটা ক্ষুদ্র মাকড়সার কাছে হেরে যাবেন না । ও যখন পারে তিনিও পারবেন , ব্যর্থতা আর হতাশাকে তুচ্ছ করে চেষ্টা চালিয়ে যেতে— যতদিন না নিজ রাজ্য ফিরে পান ততদিন । প্রয়ােজন হলে আমৃত্যু লড়াই চালিয়ে যাবেন তিনি । পরদিনই ভাের হতেই গুহা থেকে বেরিয়ে এলেন রবার্ট ব্রুস , মনে তার নতুন উদ্যম , শরীরে নতুন বল । ধীর কিন্তু দৃঢ়পায়ে এগিয়ে চললেন অরণ্যের পারে জনবসতির দিকে বাঁচতে হবে , সৈন্য সংগ্রহ করতে হবে , লড়াই করতে হবে ।
সে বারের যুদ্ধেই জয়লাভ করেছিলেন মহাবীর রবার্ট ব্রুস । সেই ছােট্ট মাকড়সাটির দেওয়া পরম শিক্ষাটি কিন্তু তিনি সারাজীবনে একদিনের জন্যও ভােলেন নি ।
You learn a much from those who have failed as from those who have succeeded . -Michael Johonson
আমাদের আর ও কবিতা রইলো তোমাদের জন্য :-👇👇
আমাদের আর ও গল্প পড়ুন :-👇👇
(২) মনের ঘরে সেই তুমি
(৩) ধূপকাঠি
(৪) কেয়ারলেস
(৫) কলঙ্ক
(৬) নতুন অতিথি
(৭) ফিজিক্যাল রিলেশনশিপ
(৮) দেবীরা বার বার ফিরে আসে না
(৯) অনুভূতি
(১০) ছলনা
0 Comments: