উইলিয়াম শেক্সপীয়র
মহাকবি শেক্সপীয়রের নাম কে না জানে ! আজ তার লেখা নাটকগুলি পৃথিবীর সব দেশে অভিনীত হয় । স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রীরা তাে বটেই সাধারণ পাঠকও তাঁর নাটকগুলি মুগ্ধ বিস্ময়ে পড়ে । মানুষের বিচিত্র চরিত্র আর মানুষের মনের অতল রহস্যের যে ছবি তিনি তুলে ধরেছেন তার নাটকে , আজও বিশ্বসাহিত্যে তার তুলনা নেই । তার লেখা সংলাপগুলাে প্রবাদ প্রবচন হয়ে আজও শিক্ষিত মানুষদের মুখে মুখে ফেরে ।
এতাে বড়াে যে মানুষটি , এই চারশাে বছর ধরে মানুষ যাঁকে এতাে সম্মান দিয়েছে , দিয়েছে এতাে ভালােবাসা , সে মানুষটার নিজের জীবন কিন্তু মােটেই খুব সুখের ছিল না । প্রদীপ যেমন নিজে পুড়ে আলাে ছড়িয়ে দেয় চারিদিকে , শেক্সপীয়রও তেমনি নিজের জীবনের অবর্ণনীয় দুঃখকষ্টের অভিজ্ঞতা দিয়ে সাজিয়ে তুলেছেন তার সৃষ্টির ঘর । তাই বােধহয় তা এমন অনবদ্য , এতাে অতুলনীয় ।
ইংল্যান্ডের স্টাটফোর্ড গ্রামের জন নামে এক ধনী ব্যবসায়ীর ছেলে উইলিয়ামের ছােটোবেলা থেকেই পড়াশােনায় মন নেই । বহু চেষ্টার পর শেষে হাল ছেড়ে দিয়ে উইলিয়ামের বাবা তাকে ব্যবসায় নামিয়ে দিলেন । পড়াশােনায় ইতি টেনে মাত্র চোদ্দ বছর বয়সেই উইলিয়ম নেমে পড়লেন ব্যবসায় । কিন্তু তাতেই বা মন বসে কই ! মন যেন সবসময় উড়ু উড়ু । কি যেন সব ভাবেন ! কাজে কেবলই ভুল হয় । পয়সাকড়ির হিসাব দিতে পারেন না ঠিকমতাে । উইলিয়ামের সর্বদাই মনে হতাে- “ কেন এসব ফালতু কাজ করে সময় নষ্ট করছি ? আমার যে কথা ছিল অনেক বড়াে কাজ করার । '
কিছুই ভালাে লাগে না । এমনি সময় হঠাৎই বিয়ে করে বসলেন । পাত্রী শুধু যে তার চেয়ে আট বছরের বড়াে— তাই নয় বেশ কয়েকটি ছেলেমেয়েরও তিনি মা । এইরকম বকা ছেলেকে কোন অভিভাবকই বা বাবা বাছা বলে আদর করবেন ? বাড়ি থেকে উইলিয়ামকে তাড়িয়ে দেওয়া হল ।
নব বিবাহিতা স্ত্রী এবং কতকগুলি নাবালক বাচ্চা কাচ্চা সমেত পথে এসে দাঁড়ালেন শেক্সপীয়র । পরিচিত আত্মীয়বন্ধুরা ভাবল অপদার্থ অপরিণামদর্শী ছোঁড়াটাকে এবার বােধহয় ভিক্ষে করতে হবে নয়তাে চুরি ডাকাতি । কিন্তু উইলিয়াম হার মানলেন না । হাল ছাড়ালেন না ।
কিছুদিন উইলিয়াম পথে পথে ঘুরলেন । পেটের দায়ে যখন যে কাজ পান তাই করেন । কিন্তু কোনাে কাজেই তিনি বেশিদিন টিকে থাকতে পারেন না ।
এর ওপরে এল আর এক বিপদ । তখন উইলিয়াম কাজ করছিলেন । এক মস্ত জমিদারের বাগান দেখাশােনার । হঠাৎ একদিন কিভাবে যেন ওই বাগানের একটি হরিণ কোথায় হারিয়ে গেল । নিশ্চয় এ পাহারাদারেরই কাজ অথবা তার অন্যমনস্কতার সুযােগে কেউ সেটিকে চুরি করেছে । যাই হােক , সব দোষ কিন্তু গিয়ে পড়ল উইলিয়ামের ওপর । জমিদার পুলিশে খবর দিলেন । বিচারে বেত্রাঘাত ও হাজতবাসের শাস্তি হলো তার ।
উইলিয়াম রাতের অন্ধকারে জেল থেকে পালালেন । তারপর আর একটি মুহূর্তও দেরী না করে সপরিবারে পালিয়ে এলেন লন্ডন শহরে ।
লন্ডন শহর ধনীদের জায়গা । উইলিয়াম লেখাপড়া কিছুই শেখেননি । হাতের কাজকর্ম বলতেও কিছু জানেন না । এতােবড় শহরে কি করে এতােগুলি মানুষের অন্নসংস্থান হবে ?
হঠাৎ একটা সুযােগ এসে গেল । তখনকার দিনে গ্লোব ছিল লন্ডনের নাম করা থিয়েটার হল । সেখানে শহরের সব নামীদামী বুদ্ধিজীবী মানুষেরা আসতেন নাটক দেখতে । একদিন নাট্যশালার পাশ দিয়ে যেতে যেতে উইলিয়াম দেখলেন এক ভদ্রলােক কাউকে যেন খুঁজছেন । উইলি কাছে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলন স্যার , আপনি কি কিছু খুঁজছেন ?
-হ্যা , আমি একটি ছেলে খুঁজছি যে আমার ঘােড়ার গাড়ির এই ঘােড়াগুলিকে কিছুক্ষণ দেখাশােনা করবে । বেশিক্ষণ নয় , মাত্র ঘণ্টা তিনেক যতক্ষণ আমি নাটক দেখতে ব্যস্ত থাকব ।
উইলিয়াম এগিয়ে এসে কাজটি নিলেন । ঘণ্টা তিনেক বাদে পারিশ্রমিকও পেলেন ভালােই । এরপর প্রতিদিনই আসতে লাগলেন সেখানে এবং ক্রমে থিয়েটারের অশ্বরক্ষকের কাজটি তার বাঁধা হয়ে গেল ।
খুবই তুচ্ছ কাজ । কিন্তু কে জানত _এই অশ্বশালা থেকেই একদিন উঠে আসবে বিশ্বের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নাট্যকার ?
উইলিয়ামের কাজে ও ভদ্র আচরণে থিয়েটারের মালিক তাঁর প্রতি খুব সদয় ছিলেন । একদিন কি কারণে য়েন থিয়েটারের জনৈক অভিনেতা উপস্থিত হতে পারলেন না । ওই চরিত্রে উইলিয়ামকে খুব সুন্দর মানাবে । এই ভেবে তক্ষুনি ডাক পড়ল তার । সেদিনের অভিনয় সুন্দরভাবে উৎরে দিলেন তিনি । এরপর থেকে প্রায়ই ডাক পড়তে লাগল তার । ধীরে ধীরে উইলিয়াম হয়ে গেলেন পেশাদার রঙ্গমঞ্চের নিয়মিত অভিনেতা । সুপ্ত অভিনয় প্রতিভা সামান্য সুযােগ পেয়েই ফুটে উঠতে লাগত ।
কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই শেক্সপীয়রের নজরে পড়ল যে অভিনেতাদের চেয়ে নাট্যকার টাকা পান অনেক বেশি । তার এখন টাকার দরকার । প্রচুর টাকা । তাই অভিনয়ের পাশাপাশি নাটক লেখাতেও মন দিলেন তিনি ।
সারা সন্ধ্যে অভিনয় করে বাড়ি ফিরে এসে নাটক লিখতে বসে গেলেন উইলি । নাটকের খুঁটিনাটি বিষয়গুলি ততােদিনে ভালােরকম জানা হয়ে গেছে তার । সঙ্গে ছিল প্রতিভা আর ছিল কিছুতেই হার না মানা নাছােড়বান্দা মনােভাব ।
তাই এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে । ঝড়ের গতিতে একের পর এক লিখে চললেন হ্যামলেট , ম্যাকবেথ , ওথেলাে , মিডসামার নাইটস ড্রিম , কমেডি অব এরর্স , এ্যান্টনী ক্লিওপেট্রা , রােমিও জুলিয়েট ইত্যাদি সব কালজয়ী নাটক ।
ততদিনে অর্থাভাবও দূর হয়েছে । তাই ঐতিহাসিক নাটকগুলি লেখার প্রয়ােজনে নিজের খরচেই বইপত্র কিনতে লাগলেন । পড়তেও লাগলেন ঝড়ের গতিতে । গা থেকে আকাট মূখের কোটটা তার খুলে পড়তে দেরী হলাে না ।
স্বশিক্ষিত উইলিয়াম শেক্সপীয়র ক্রমে ক্রমে হয়ে উঠলেন মহাপণ্ডিত ।
অন্নের অভাবে একদিন যাকে রাতের পর রাত জেগে নাটক লিখতে হত তিনিই হলেন প্রচুর প্রচুর অর্থের মালিক । নিজের জন্মভূমি ষ্ট্যাটফোর্ডে গিয়ে বিশাল জমিদারি কিনে রাজার হালে বসবাস করতে লাগলেন । যারা একদিন এ গ্রাম থেকে তাঁকে তাড়িয়ে দিয়েছিল তারাই দেখল সারা বিশ্বের অসংখ্য শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত মানুষ তাকে দেখবার জন্য ছুটে আসছে । জগৎজোড়া কতাে সম্মান তার । কতাে মানুষের শ্রদ্ধা আর ভালােবাসা তার জন্যে সাজানাে ।
মৃত্যুর পর তাঁরই জমিদারির অন্তর্গত ওয়েস্ট মিনস্টার এ্যাবেতে তাকে সমাহিত করা হল । আজও তাঁর গুণমুগ্ধ লক্ষ লক্ষ মানুষ তার সমাধিতে পুস্পার্ঘ নিবেদন করতে আসে । আসে পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে । যদি হাল ছেড়ে দিতেন , হার মানতেন তবে এই শেক্সপীয়রকে কি পেত , আমাদের এই পৃথিবী ?